সকালে বাসা থেকে বের হয়ে বেশ গরম অনুভব করছিলাম। শীত শেষে আজই প্রথম মনে হলো গরম পড়েছে। অফিসে এসে ক্যালেন্ডারে চোখ রেখে দেখলাম, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। চৈত্র মাস পড়েছে। ব্যস্ততায় দিন-তারিখ আমি ভুলে যেতে চাইলেও আমাকে ভুলতে দেয় না চৈত্র। বছরের সবচেয়ে বেশী গমর পড়ে এই সময়টাতে। অনেকেই খুব বিরক্ত হন। কিন্তু আমার কেন জানি খুব ভালো লাগে এই সময়টাতে। সারি সারি সস্তা শরবতের দোকান বসবে রাস্তার দুই ধারে। তৃষ্ণার্ত পথিকেরা ভিড় জমাবেন সেই দোকানে। দুপুরে নিজের রিকশায় হুড তুলে বিরস মুখে বসে থাকবেন রিকশাওয়ালা। বারবার অনুরোধ করার পরেও যেতে রাজি হবেন না। তার ওই এক মুহূর্তের স্বাধীনতা উপভোগ, আমার বড্ড ভালো লাগে।
দরদর ঘামে ভেজা হাতটি বাসের ভিড় ঠেলে বাইরে বেরুবে শশার প্রত্যাশায়। আমি জানি এ সব কিছুই অসহনীয়। কিন্তু আমার ভালো লাগে। আমি কি করবো? তীব্র গরমে এক হঠাৎ বয়ে যাওয়া হাওয়া, আমাকে নিয়ে যায় ২০ কিংবা তারও অধিক পেছনে। আমার স্কুলে টিফিন হতো দু’টোয়। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে যে যার টিফিন বক্স খুলে বসতো। এই তীব্র গরমে মাঠে যাবার স্পর্ধা খুব কম ছাত্রই দেখাতো। আমি ছিলাম তাদের দলে। নিজের টিফিনটা হয়তো কাউকে গছিয়ে দিয়ে এক দৌড়ে পৌছে যেতাম মাঠে। আধাঘণ্টার টিফিন পিরিয়ড, নষ্ট করা যাবে না এক মুহূর্তও। আসলে স্কুলে ঢোকার পর থেকে তো অপেক্ষা এটাই ছিল। একটুও ক্লান্ত হয়নি কখনো। ঝাঁঝাঁ দুপুরে রোদে কয়লা হয়ে টিফিন শেষের শেষ ঘণ্টায় টিপ কলে মুখ দিতাম। এক চুমুকে জুড়িয়ে নিতাম সবটা তৃষ্ণা। ঘামে চিপচিপে ভেজা শরীরে ঘাসের গন্ধ মেখে বাকীটা সময় পার করতাম।
লম্বা দুপুর পেরিয়ে অবশেষে ছুটির ঘণ্টা। তখনও সূর্য ঠাঁই পুড়িয়ে যাচ্ছে আমায়। অথচ আমি বরাবরই উপভোগ করেছি চৈত্র বৈশাখ। ছুটির পর বন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ফিরেছি বাড়ি। কাঁচা আমের টক আর ডাল দিয়ে খেয়েছি ভাত। বিকেলে আবারো দৌড় মাঠে। চৈত্রের মাঠে পৃথিবীর সেরা গন্ধ। ঘাস দহনের ঘ্রাণ। যারা বোঝেননি বা আবিষ্কার করতে পারেননি তারা দুর্ভাগা। আমি সৌভাগ্যবান। তবে দুঃখ আমারো ছিল ঢের। হয়নি জলে নামা। সাঁতার না পারার কারণে এই সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে দেখেছি ধুলোবালি মেখে দিনের সব খেলা শেষে বন্ধুদের ঝাঁপিয়ে পড়া নারকেল পুকুরে। পুকুরের ওপর দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তো দুষ্টু ছেলের দল। আমি ছিলাম সে দলের সাঁতার না জানা একমাত্র দর্শক।
এখন অবশ্য সে সব কিছুই নেই প্রতিদিনের জীবনে। যা ছেড়ে এসেছি তা ফিরে পেতেও চাই না। এখন আমি শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে অনেক বেশী সাচ্ছন্দ্য বোধ করি। চৈত্র-বৈশাখ স্পর্শ করতে পারে না আমাকে। অন্তত এটাই বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু কেন হঠাৎ আমায় আজ চৈত্র ছুঁয়ে গেলো ঠিক বোধগম্য নয়। শুনেছি শীত বসন্ত ছোঁয়, আমার হলো কি! আমায় চৈত্র ছুঁয়ে দিলো। বিনা কারণে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে শৈশব-কৈশরে।
আমার এক বন্ধু ছিল নাম তপু। আমরা দু’জন এই সময়ে আট আনায় দুটি কাঠি আইসক্রিম কিনতাম। একটা লাল অন্যটা সুবজ। উদ্দেশ্য, যেন দুই রঙের আইসক্রিমেরই স্বাদ নিতে পারি। চুক্তি ছিলো আমি এক কামড় দেবো ওর আইসক্রিমে বিনিময়ে এক কামড় দেবার সুযোগ পেতো তপু। এভাবে যতক্ষণ চলে আইসক্রিম। স্কুলের সাদা সার্ট, ঠোঁট, জিহ্বা সব রঙিন হয়ে যেতো আইসক্রিমের রঙে। সেই সাথে জীবনও। এখন হয়তো জীবনটা রঙিন না। অহেতেুক কিছু রঙিন স্বপ্নে বিভোর। এই স্বপ্ন আমাকে আর আনন্দ দেয় না। যে জীবন ফেলে এসেছি তা ছিল স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশী রঙিন। অনেক বেশী স্বপ্নের। তাই হয়তো।
তবে সব কিছু ফেলে আসিনি, এখনো আমার পিছু ছাড়েনি চৈত্র। নয়তো কেনই বা যান্ত্রিক এই নগরে চৈত্রের উষ্ণ স্পর্শ। কেনই বা জানিয়ে দেয়া তুমি আছো কিবা নেই আমি ঠিকই আছি বাংলা বছরের শেষ, জানান দিতে তীব্র দাহ নিয়ে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)