সগিরা মোর্শেদ (৩৫) বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআইডিএস) গবেষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শিক্ষা জীবনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ অনার্স এবং অর্থনীতিতে এম এ সম্পন্ন করেন।
সগিরা মোর্শেদের স্বামী আবদুস ছালাম চৌধুরীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে তাদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাদের তিন কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে চাঞ্চল্যকর সগিরা মোর্শেদ খুন হওয়ার ৩০ বছর পর ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বৃহস্পতিবার ১ হাজার ৩০৯ পৃষ্ঠার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে পিবিআই। এরমধ্যে পিবিআইয়ের ৬০৭ পৃষ্ঠার চার্জশিট। বাকি পৃষ্ঠা পূর্বের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ও গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ঘটনার পুরোপুরি ৩০ বছর পর মামলাটির তদন্তভার পায় পিবিআই। তদন্তভার পাওয়ার পর তিন ধাপে মোট ছয়মাস পর চারজনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হচ্ছে। দীর্ঘ ৩০ বছর পর এটিকে একটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। হত্যাকাণ্ডে ৪ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড চেয়ে চার্জশিট দাখিল করা হচ্ছে।
মামলার আসামিরা হলেন- নিহতের বড় ভাসুর ডা. হাসান আলী চৌধুরী, বড় ভাসুরের স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা ওরফে শাহীন, হাসান আলীর শ্যালক আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান এবং ভাড়াটে খুনি ও ডা. হাসানের রোগী মারুফ রেজা।
পারিবারিক কলহের জের ধরে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকাল পাঁচটায় তাকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে খুন করা হয়।
সগিরা মোর্শেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে পরিবারে ঈর্ষা তৈরি
পারিবারিক দ্বন্দ্ব বাদেও সগিরা মোর্শেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য বাড়ির অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে মনোমালিণ্যের সৃষ্টি হয়। সগিরা মোর্শেদের স্বামীর বড় ভাইয়ের নাম সামছুল আলম চৌধুরী। মেজো ভাই চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী। তিনজনই তাদের পরিবার নিয়ে আউটার সার্কুলার রোডে তখন বসবাস করতেন। সগিরা মোর্শেদরা থাকতেন দ্বিতীয় তলায়। চিকিৎসক হাসান তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনকে নিয়ে থাকতেন ওই বাসার তৃতীয় তলায়। শাহীন তিন তলা থেকে প্রায় সময় ময়লা-আবর্জনা ফেলতেন, যা সগিরা মোর্শেদের পেছনের রান্না ঘর ও সামনের বারান্দায় পড়ত। সগিরার চার তলা ছিল অধিক সুন্দর ও পরিকল্পিত। এ নিয়ে সগিরার সঙ্গে মাহমুদার প্রায় ঝগড়াঝাটি হতো। আর শাশুড়ি থাকতেন সগিরার সঙ্গে। তার শাশুড়ি তাকে ভালোবাসতেন। সগিরা তার বড় জা শাহীনকে তুমি করে বলায় দ্বন্দ্ব আরও চরমে উঠে। এক পর্যায়ে শাহীন “তোমাকে দেখে নিব বলে হুমকি” দেয়।
পিবিআই বলছে, পারিবারিক তুচ্ছ কারণ হাসান আলী ও তার স্ত্রী মাহমুদার মনে ইগোর জন্ম হয়। এক সময় মাহমুদা সগিরাকে শায়েস্তা করার জন্য তাঁর স্বামী হাসানকে বলেন। হাসান তাতে রাজি হন। চিকিৎসক হাসানের রোগী ছিলেন মারুফ রেজা।
জানা যায় মারুফ রেজা তৎকালীন সিদ্ধেশ্বরী এলাকার সন্ত্রাসী ছিলেন। আর এই মারুফ ছিলেন সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগিনা।
জাতীয় পরিচয় পত্রে ইচ্ছা করে ভুল জন্ম তারিখ দেন মারুফ
আসামি মারুফ রেজার জাতীয় পরিচয় পত্রে জন্ম তারিখ দেওয়া ছিল ১৯৭২ সালের ২৯ আগস্ট। সে অনুপাতে সগিরা মোর্শেদ হত্যার সময় মারুফের বয়স ছিল ১৬ বছর ১০ মাস ২৬ দিন।কিন্তু পিবিআইয়ের তথ্যমতে মারুফ যখন উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি হয় তখন ভর্তির রেজিষ্টার অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১০ই মার্চ।
আসামিদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত অভিযোগ
পিবিআই বলছে আসামিরা একই উদ্দেশ্য সাধন কল্পে খুনের পরিকল্পনা করে এবং খুন করে। এছাড়াও অপরাধীদেরকে গোপন করার জন্য অপরাধের সাক্ষ্য অদৃশ্য করে দেওয়া এবং মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য বাদিকে অপরাধ মূলক ভয়ভীতি প্রদর্শন করা।
হত্যাকাণ্ডের আলামত পায় নি পিবিআই
৩০ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের কোনো আলামতই জব্দ করতে পারে নি পিবিআই। হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যবহৃত মোটর সাইকেলটি (হোন্ডা-সিডিআই ১০০) পরে হাতবদল হয়ে যায় মো. আনোয়ার হোসেনের কাছে। তিনি আদালতে ১৪৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যে রিভলভার দিয়ে মারুফ গুলি করে সেটা ছিল সন্ত্রাসী মনু মিয়া ওরফে হরর মুন্নার। যিনি অন্য একটি মামলায় রূপগঞ্জে ২০০৫ সালের ২৮ নভেম্বর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
যে রিকশায় সগিরা মোর্শেদ যাচ্ছিলেন ডিবি তদন্তকালীন সময়ে রিকশাটিকে জনৈক মো. ফজলুল করিমের কাছে জিম্মা দেওয়া হয়। কিন্তু পিবিআই জানায় তদন্তকালীন সময়ে রিকশার অস্তিত্ব ও জিম্মাদারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জিম্মাদারের যে ঠিকানা ছিল তেজকুনীপাড়ার রেলওয়ে কলোনী এবং চাটখিল নোয়াখালীর খুমাতলী এলাকাতে খোঁজ নিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে সগিরা মোর্শেদের পোশাক ও অলংকারাদি এবং ব্যাগের মধ্যে থাকা কিছু টাকা অ্যাডভোকেট শহীদ উদ্দিন শনাক্তকারী হিসেবে থেকে ১৯৯২ সালের ৯ জুন (মালখানা রেজিস্টার এমও নং-৩৯/৯২) আদালতে দাখিল করেন। কিন্তু ওই অ্যাডভোকেট মারা যাওয়ায় জব্দ করা আলামত আর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।