নানা অনিয়ম অার লোকসানের ভারে ডুবতে থাকা বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) পাট নিয়ে নতুন আশার আলো দেখছে। এরই মধ্যে গত দুই বছরে লোকসানের পরিমাণ ৩০৬ কোটি টাকা কমিয়ে এনেছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসানের পরিমাণ ছিল ৭২৬ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। পরের দুই অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪২০ কোটি টাকা
প্রতিষ্ঠানটির লাভ-ক্ষতি, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পাটের বাজার, শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক, বাজার বাড়াতে নানামুখি পদক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন বিজেএমসির চেয়ারম্যান ড. মাহমুদুল হাসান।
গত দুই বছরে বিজেএমসি ৩০৬ কোটি টাকা লোকসান কমিয়ে এনেছে। এর পেছনে কোন কোন উপাদান/উদ্যোগ কাজ করেছে?
মাহমুদুল হাসান: আমরা বিগত বছরগুলোর লোকসানের কারণ হিসেবে বেশ কিছু ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছি। প্রথমত, ১০ থেকে ১২টি কারণ সামনে রেখে আমরা এগিয়েছি। তবে, সবগুলো বিষয় সমাধান করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও সর্বোচ্চ দিয়ে আমরা চেষ্টা করছি। যার ফল আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। প্রথমত আমরা পাট কেনার দিকে নজর দিয়েছি। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ঠেকাতে আমরা বিশেষ ব্যাবস্থা নিয়েছি। পাট ক্রয় কেন্দ্র ১৮০টি থেকে কমিয়ে ৬৬টিতে নামিয়ে এনেছি। তবে এ বছর ৭১টি কেন্দ্র থেকে বিজেএমসি পাট কিনছে। এতে পাট কেনায় ব্যবস্থাপনা খরচ অর্ধেকে নেমে এসেছে।
লোকসানের জন্য খাতওয়ারি কোন কোন কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে? লোকসান সম্পূর্ণ কমিয়ে আনতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে? তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি কতটুকু?
মাহমুদুল হাসান: আগের সময়টাতে দেখা যেত পাটের যোগানের অভাবে বছরের অনেকটা সময় শ্রমিকদের বসিয়ে বেতন দিতে হতো। সেটা একটা ম্যানেজমেন্টের আওতায় নিয়ে এসে কিভাবে সারা বছর পাটের ফ্লোটা ঠিক রাখা যায় সে চেষ্টা করছি। এক্ষেত্রে পাট ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি। এখন থেকে পাট না থাকার কারণে কোনো শ্রমিকে বসে থাকতে হবে না।
এরপর যে বিষয়টি আমাদের সামনে এসেছে; সেটি হলো ফলস হাজিরা। দেখা যেত অনেকেই অফিসে না এসেই স্থানীয় প্রভাব দেখিয়ে মাসের পর মাস বেতন তুলে নিচ্ছে। এটা যাতে না হয় বিজেএমসির পক্ষ তা নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রডাকশন সিস্টেম। এটা আগেও ছিলো। তবে, আগে ঠিক মতো মনিটরিং করা হতো না। এখন সেটা আমরা নিশ্চিত করছি। এই ধরেন: একটা মেশিনে এক টন পাট থেকে প্রডাকশন বের করে আনতে কত জন শ্রমিকের প্রয়োজন? তার একটি স্ট্যান্ডার্ড আছে। আমরা সেটি অনুসরণ করে ঠিক ততজন শ্রমিকই নিয়োগ করছি। এ ব্যাপারে মিলের প্রকল্প প্রধানদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এরপরও যদি কোথাও কোনো ব্যাতিক্রম হয় তাহলে সেটা তাদের ব্যক্তিগত দায় হবে। ফলে এক টন পাট থেকে প্রডাকশন বের করে আনতে যে কজন শ্রমিকের প্রয়োজন হতো তা স্ট্যান্ডার্ডের কাছাকাছি নিয়ে আসছে। সেন্ট্রাল অথরিটি ম্যানেজমেন্ট থেকে এটি কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তাতে, করে সুফল আসছে।
এর পাশাপাশি মেলার আয়োজন এবং কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর আগের তুলনায় অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে। এতে করে অপারেশনাল কস্ট এবং ম্যানেজমেন্ট কস্ট কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। আবার, যারা ভালো কাজ করছে, তাদের স্বীকৃতি হিসেবে আমরা বিদেশে পাঠাচ্ছি। এটাও কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টিতে ভালো কাজ করছে।
আমাদের লোকসানের আরেকটি বড় কারণ সময় মতো পাট কিনতে না পারা। মৌসুমের শুরুতেই যদি আমরা পাট কিনতে পারতাম তাহলে ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হতো। আমাদের কিছু ব্যাংক ঋণ রয়েছে। প্রতি বছর এর সুদ হিসেবে ৮০ থেকে ৮২ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যদি অল্প সুদে ঋণ পাওয়া যেত তাহলে লোকসানটা আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হতো।
দুর্নীতির সমস্যাটা তো আছেই। এক্ষেত্রে আমরা আইনের আশ্রয় নিচ্ছি, কোর্টের আশ্রয় নিচ্ছি। এসকল পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে আসছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রী মহোদয় আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছেন। আমি এতটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি: বিজেএমসিতে আগে যে দুর্নীতি ছিলো এখন সেটা আর নেই।
কাঁচা পাট কেনার পদ্ধতির স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কোন কোন নতুন বিষয়গুলো যুক্ত হয়েছে? সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে?
মাহমুদুল হাসান: কাঁচা পাট কিনতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আমরা একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করেছি। প্রত্যেক ক্রয় কেন্দ্রের প্রধানকে একটি ট্যাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন তারা যে পাট কিনবে আমরা ঢাকা থেকে মনিটর করছি। এই যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমরা মনিটর করছি; এটার একটা সুফল আসছে। কেউ কোনো অনিয়ম করতে এখন ভয় পাবে। আজকে পাট কিনে পরের দিন দেখাতে পারবে না। আবার খারাপ কোয়ালিটির পাট কিনে ভালো কোয়ালিটি দেখাতে পারবে না। তারপরও যে দুর্নীতি হচ্ছে না, তা নয়। একশত ভাগ সফলতা এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি। অনেক জায়গায় আজ পাট কিনে পরের দিন দেখাচ্ছে। কম দামে কিনে বেশি দাম দেখাচ্ছে। আমরা যখনই কোনো অভিযোগ পাচ্ছি তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। পাট কেনার ব্যাপারে যারা জড়িত তারা আগের থেকে সচেতন হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা কী রকম? চাহিদা বাড়ানোর জন্য কোন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
মাহমুদুল হাসান: সুদান এবং আফ্রিকান দেশগুলো আমাদের বড় বাজার। এরপরই রয়েছে ভারত। ভারতে বিগত বছরগুলোতে ৩০০ কোটি টাকার মতো কাঁচা পাট এবং পাট পণ্য রপ্তানী হতো। কিন্তু ভারত সরকার এন্টি ডাম্পিং ডিউটি ফি আরোপ করায় সেটা অনেক আংশে কমে এসেছে। ৩০০ কোটি টাকার বাজার এখন ৩০-৩২ কোটিতে নেমে আসছে। এখানে বিজেএমসি’র কিছু করার নেই। সরকার এন্টি ডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহারের জন্য চেষ্টা করছে। এটা যদি সম্ভব হয় তাহলে হয়তো ভারতের বাজারটা আমরা আবারও ধরতে পারবো। অন্যান্য দেশে আমাদের রেগুলার পাট পণ্য বিক্রি হচ্ছে। তবে বিজেএমসি মনে করছে: এখন পর্যন্ত আমাদের যে বাজার রয়েছে সেটা যথেষ্ট নয়। আগের বাজার ধরে রেখে এটাকে আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে মিশনগুলোকে আমরা কাজে লাগাচ্ছি। বৈদেশিক মেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করছি। তবে, আমাদের যে মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট রয়েছে সেটা যথেষ্ট কার্যকর নয় বলে আমি মনে করছি। আমাদের এক্সপার্টের অভাব রয়েছে। প্রথাগত মার্কেটিং দিয়ে আসলে এখনকার বাজার ধরে রাখা কঠিন।
বাধ্যতামূলক মোড়ক আইন প্রবর্তনে ইতিবাচক কোন কোন পরিবর্তন এসেছে? আইন বাস্তবায়নে কোন কোন বাধা রয়েছে? তা থেকে উত্তরণে সুপারিশ কী?
মাহমুদুল হাসান: ম্যান্ডেটরি প্যাকেজিং অ্যক্টের আওতায় যে ১৭টি পণ্য রয়েছে; সেগুলোতে পাট পণ্যের ব্যবহার এখন পর্যন্ত সেভাবে নিশ্চিত হয়নি। এখন পর্যন্ত বাজারে পলিথিনের ব্যাগ পর্যাপ্ত। তারা যেহেতু কম দামে এ সব ব্যাগ পাচ্ছে; তাই পাট পণ্যের দিকে কম ঝুঁকছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত হলে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাড়ে। এজন্য পাট অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জিও টেক্সটাইলের ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
মাহমুদুল হাসান: জিও টেক্সটাইলের ব্যবহার বাড়ানো গেলে আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। গ্রামের রাস্তাগুলো দেখা যায় বর্ষা আসলেই ভেঙে যায়। এখানে জিও টেক্সটাইলের ব্যাগ ব্যাবহার করে রাস্তার ভাঙন ঠেকানো পরিবেশ সম্মত। এজন্য এরই মধ্যে আমরা রোডস এন্ড হাইওয়ে-এলজিডি’র সঙ্গে বসে আলোচনা করেছি। তাদের ব্যবহার্য পণ্যের তালিকায় পাটের ব্যাগের অন্তর্ভূক্তির জন্য আমরা অনুরোধ করেছি। আবার যেসকল প্রতিষ্ঠার সরাসরি মাটি ক্ষয়ের সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে পাট পণ্য ব্যবহারের জন্য আমরা বলছি। এতে করে আমাদের পণ্যও বিক্রি হলো। আবার মাটি ক্ষয়েরও একটা সমাধান মিললো। আমরা তাদের সঙ্গে অফিসিয়ালি মিটিং করছি আবার কর্মশালা আয়োজনের মাধ্যমে তাদের সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
শ্রমিকদের বর্তমান দাবিগুলো (ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নসহ ১১ দফা) পূরণে বিজেএমসি কর্তৃপক্ষের অবস্থান কী?
মাহমুদুল হাসান: ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আসলে আমাদের কিছু করার নেই। এটা সরকারের হাতে। এরই মধ্যে এ বিষয়ে মিটিং হয়েছে। হয়তো খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত আসবে। এক্ষেত্রে বিজেএমসি’র অবস্থান হলো সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে বিজেএমসি তা বাস্তবায়ন করবে।
তবে এক্ষেত্রে বিজেএমসির হয়ে আমার কথা হলো: আমরা একজন নুতন শ্রমিককে যে টাকা দিচ্ছি তা দিয়েই প্রোডাকশন কস্ট কুলানো যাচ্ছে না। সেখানে আবারও বেতন বাড়ানো হলে আমরা হুমকির মুখে পড়বো। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেখানে নতুন শ্রমিককে ৪ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৪ টাকা মাসিক বেতন দিচ্ছে; সেখানে আমরা দিচ্ছি ১১ হাজার ১৫০ টাকা। দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। আমাদের লেবার কস্ট অনেক বেশি হচ্ছে। যার কারণে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে পারছি না।
গত বছর আমরা একটা সমীক্ষা করেছি সেখানে দেখা যাচ্ছে ৩৭০ কোটি টাকা আমরা বেসরকারি খাত থেকে অতিরিক্ত খরচ করছি শুধু শ্রমিক বেতনেই। ৪২০ কোটি টাকার যে লোকসান রয়েছে সেটা কিন্তু এখান থেকেই কাভার করা সম্ভব। লোকসানের মধ্যে এটা অন্যতম একটা কারণ। এ ক্ষেত্রে আমরা সরকারের কাছে প্রস্তাব রেখেছি: এই সমপরিমাণ অর্থ সরকার যেন বিজেএমসিকে ভর্তুকি দেয়। না হলে বেসরকারি খাতকেও যে একই বেতন কাঠামোর আওতায় আনা হয়।
শ্রমিক সংগঠনগুলো মিলের স্বার্থে কীভাবে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পারে? শ্রম সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোন কোন উদ্যোগ নিয়েছে?
মাহমুদুল হাসান: শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত বহুবার আমি শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিটিং করেছি। তারা যেভাবে কথা বলে; তাতে কারখানাগুলোর উন্নতিরই কথা বলে। তারা এসে তাদের মিলের সমস্যাগুলো তুলে ধরে। বলে, “আমার মিলে এ সমস্যা, আমার মিলে এত লস!” আসলে তারা মিলগুলোকে ওন করে। কিন্তু বড় সমস্যা হলো আমরা তাদের মজুরি সময় মতো দিতে পারছি না। আমরা যদি সময় মতো মজুরি না দিতে পারি; তাদের দিয়ে কাজ করাতে পারবো না। পেট খালি থাকলে কারও-ই কাজ করা আগ্রহ থাকবে না। এক্ষেত্রে আমি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো।
চ্যানেল আই অনলাইন: আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহমুদুল হাসান: চ্যানেল আই অনলাইনকেও ধন্যবাদ।