পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কেমন চলেছিলো বাংলাদেশ, সে সম্পর্কে তেমন পরিষ্কার কোনো বিবরণ নেই। ওই দুই মাসের ঘটনা নিয়ে বই বা অন্য লেখালেখিও কম হয়েছে। তবে পঁচাত্তরের নভেম্বরটা খুব ঘটনাবহুল হওয়ায় যারা স্মৃতিকথা যারা লিখেছেন তাদের লেখা এবং এখনো যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকেই জানা যাচ্ছে সব। নভেম্বর ছাড়া আমরা অবশ্য ওইসব দিনের কথা যেমন আলোচনা করি না, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সে সময়ের নিরপেক্ষ একটি ঘটনাপঞ্জির অভাবও অনুভূত হয় বারবার। সেজন্যই আমরা ডিবিসি নিউজের উদ্যোগে পুরো অক্টোবর মাস জুড়ে আটপর্বের ধারাবাহিক আলোচনা করেছি ‘উপসংহার’ অনুষ্ঠানে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে নভেম্বর ‘৭৫ নিয়ে এখনো মানুষের মধ্যে যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। এমনকি ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়ার পরও পুরোপুরি সব ঘটনা উদঘাটিত হয়নি। আর যেসব বই এখন পর্যন্ত আমাদের হাতে আছে তাতে ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা যতটা বেশী, ঘটনার নির্মোহ বিশ্লেষণ এবং সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহের নিরপেক্ষ বর্ণনা ততটাই অনুপস্থিত। সেজন্যই আরো বেশী আলোচনা ও গবেষণা দরকার পঁচাত্তরের নভেম্বরের ঘটনাবলী নিয়ে ।
৩ নভেম্বর অভুত্থান ঘটিয়ে খালেদ মোশাররফ নিজে সেনাবাহিনী প্রধান হয়ে জেলহত্যার বিস্তারিত তথ্য উদঘাটনে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আদেশ জারী করাতে পারলেও পরবর্তিতে সেই কমিশন কোনো কাজ করেনি। ডিবিসি নিউজের আলোচনায় ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন দাবি করেছেন, ৩ দিন পরই এটা জিয়াউর রহমান বাতিল করে দেন।অনেক ঘটনার আড়ালে এই বিষয়টা চাপা পড়ে গেছে। কেন উনি এটা বাতিল করলেন? নিশ্চয়ই একটা কারণ আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একটা গোষ্ঠি ক্ষমতা দখল করেছে। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে ৩ নভেম্বরে উনাদের (জাতীয় চারনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এ এইচ কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলী ) খুন করার কি দরকার ছিলো?
আটটি আলোচনা থেকে যতটুকু বোঝা গেছে তাতে বলাই যায় যে যখন খন্দকার মোশতাক বুঝতে পেরেছিলেন যে খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান নিয়োগের পর তার পক্ষে আর রাষ্ট্রপতির পদে থাকা সম্ভব নয়, তখনই তিনি কারাগারে থাকা আওয়ামী লীগের শীর্ষ চারনেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। কারণ এই চারনেতাসহ অন্য যারাই মোশতাকের সঙ্গে হাত মেলাননি, তাদের সবাইকেই জেলে পোরা হয়েছিল। যেহেতু এই চারনেতা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে, এবং কোলকাতায় এদের খুব কাছে থেকে দেখেছেন খন্দকার মোশতাক, তাই বঙ্গভবনে খুনী ফারুক-রশীদ চক্রের সাথে মিলেই চারনেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। খন্দকার মোশতাক একদিকে খালেদ মোশারফকে সেনাপ্রধান করে ফারুক-রশীদ চক্রকে দেশ থেকে চলে যাবার সুযোগ আদায় করেছেন, অন্যদিকে নামকাওয়াস্তে তদন্ত কমিশন গঠনে রাজী হয়েছেন । ৩ নভেম্বর যখন অভুত্থান ঘটিয়ে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করতে ব্যস্ত খালেদ মোশাররফ ও শাফায়েত জামিলরা তখনই ঘটে জেল হত্যাকাণ্ড।
শাফায়াত জামিল লিখেছেন: ৪ নভেম্বর সকাল ১০টা নাগাদ স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই এ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মোশাররফ চতুর্থ বেঙ্গলের হেড কোয়ার্টারে এলেন। তাদের মুখেই প্রথম শুনলাম জেল হত্যাকাণ্ডের কথা। এ ঘটনার কথা শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত কয়েক দিনের জন্য মোশতাককে স্বপদে বহাল রাখতে চেয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ, যা আমি অনিচ্ছা সত্বেও সব দিক বিবেচনা করে মেনে নেই। চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় এভাবে হত্যা করার কথা শুনে আমি খালেদ মোশাররফকে বললাম ‘মোশতাককে এক্ষুনি অপসারণ করুন আপনি’।
৪ নভেম্বর রাতেই মোশতাককে গৃহবন্দি করা হয়, বঙ্গভবনেই। এর আগেই খন্দকার মোশতাক তার পদত্যাগপত্র, খালেদ মোশাররফকে সেনাপ্রধান এবং জেলহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন আদেশে সই করেন। একই দিনে মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। জেল হত্যাকাণ্ডের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে কর্নেল শাফায়াত জামিল তার লেখা বইতে উল্লেখ করেছেন।
ওই সময়ের বিভিন্ন স্মৃতিচারণমূলক বইগুলো পড়লে বোঝা যায় ১৫ আগস্টের পর ৩ নভেম্বর পাল্টা ক্যু করে খালেদ মোশাররফ মোশতাককে অপসারণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। আর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে একটি পদত্যাগপত্র আদায় করতে পারলেও পুরো সেনাবাহিনীর ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ঢাকা স্টেশন কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল এ অভুত্থানের মূল দায়িত্বে থাকলেও সেনাবাহিনীর অন্যান্য ইউনিটগুলো তার নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দি করাটাও গ্রহণযোগ্য হয়নি সাধারণ সেনা সদস্যদের কাছে। সেনাবাহিনীতে খালেদ মোশাররফের চেয়ে জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা অনেক বেশী ছিল। ঢাকার সেনা কর্মকর্তা এবং সৈনিকদের ওপর আস্থা কম থাকায় রংপুর ব্রিগেড থেকে দুই ব্যাটেলিয়ন এবং কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে এক ব্যাটলিয়ন সৈন্য ঢাকায় পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন অপেক্ষাকৃত দৃর্বল সেনাপ্রধান, মাত্র কয়েকদিনের মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ। তার ডাকে সাড়া দিয়ে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন কর্নেল হুদা যিনি নিহত হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফের সাথেই । আরো এসেছিলেন কর্নেল (অব) জাফর ইমাম বীর বিক্রম। নিজের লেখা “দাম দিয়ে কিনেছি এই বাংলা” বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে ‘অভ্যুত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে খালেদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের কোনো মানসিক প্রস্তুতি এমনকি পরিকল্পনাও ছিল না। এ কারণে এই অভ্যুত্থানের সাথে সম্পৃক্ত অফিসারেরাও করণীয় সম্পর্কে দ্বিধাদ্বন্ধে ছিল।’
জাফর ইমাম এবং শাফায়েত জামিলের বই পড়লে মনে হয় খালেদ মোশাররফের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সেনাপ্রধান হওয়া। জাফর ইমাম তার বইতে লিখেছেন: জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ উল্লাহর নেতৃত্বে একদল সৈন্য। তারা জিয়ার বাসার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলেন। তখন নাকি জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্রপতি হবারও প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। জাফর ইমাম তার বইতে লিখেছেন: এই অফিসারেরা খালেদের পক্ষ থেকে কিংবা রসিকতা করে এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিনা জানি না। জিয়া ঠাণ্ডা মাথায় তাদেরকে উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমার প্রেসিডেন্ট হওয়ার সখ নেই,আমাকে কাগজ কলম দাও আমি অবসর গ্রহণের জন্য দরখাস্ত করবো। আমাকে পেনশন পাঠালেই খুশি থাকবো।
ইতিহাস হলো বন্দি জিয়াউর রহমান মাত্র চারদিনের মাথায় ৭ নভেম্বর বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। সেনাপ্রধান, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং সবশেষ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিও হয়েছিলেন। আর গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সেই দল এখন মাঠে লড়ছে ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনে জনসভা করার জন্য।
খন্দকার মোশতাককে যে অপসারণের চিন্তা খালেদ মোশাররফের ছিল না, তার প্রমাণ মেলে যে ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় গিয়ে অভ্যুত্থানকারীরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের জন্য অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। ওই সন্ধ্যায় তখনকার সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ, বিমান বাহিনী প্রধান এম জে তাওয়াব এবং নৌবাহিনী প্রধান এম এইচ খান বিচারপতি সায়েমের বাসায় গিয়েছিলেন। প্রথমে শারীরিক অসুস্থতার কথা বললেও একটু পরেই তিনি বলেছিলেন “আলহামদুল্লিাহ” ।
এই ঘটনার বিবরণ আছে শাফায়েত জামিলের লেখা ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ বইটিতে ।
১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন বিচারপতি সায়েম। আর যখন বঙ্গভবনে শপথ চলছে তখন জাসদের গণবাহিনী ও সৈনিক সংস্থা আরেকটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে। ব্যর্থ বিপ্লব আর সংহতির নায়ক কর্নেল তাহেরের ভাই ড. মো. আনোয়ার হোসেন তার বইতে লিখেছেন: ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় ইউসুফ ভাইয়ের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আনোয়ার সিদ্দিকের গুলশানের বাড়িতে সিপাহী-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের অপারেশনাল পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়।
খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানের সাথে রাজনীতির কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না বলেই একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু খালেদ মোশাররফের ঘনিষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব) নাসির উদ্দিন আমাদের ‘উপসংহার’ অনুষ্ঠানে এসে বলেছেন যে তাদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সাথেই যোগাযোগ করা হয়েছিল। এদের মধ্যে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কর্নেল তাহের, রাশেদ খান মেনন, সর্বহারা পার্টির জিয়াউদ্দিন এবং খালেদ মোশাররফের ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ ছিলেন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন নিজের লেখা বইয়ে।
নিজের লেখা বইতে নাসির উদ্দিন অক্টোবর মাসের কোনো এক সময় খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ধানমন্ডির বাসভবনে বৈঠকের কথাও লিখেছেন। (চলবে… )
(৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবর মাস জুড়ে ‘ডিবিসি’ টেলিভিশনে আট পর্বে ‘উপসংহার’ নামে একটি টক-শো করেছেন ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা। সেই টক-শোতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং অন্যান্য বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি চ্যানেল আই অনলাইন’র জন্য এ ধারাবাহিকটি লিখছেন। টক-শো’র মতো এখানেও তিনি সবার চোখ দিয়ে ৭৫’র নভেম্বরের ঘটনাগুলোতে দৃষ্টিপাত করে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।)