Site icon চ্যানেল আই অনলাইন

রাজশাহীর পদ্মার পাড়ে

পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটুখানি দেরি হয়ে যায়। অস্তগামী সূর্যের কুসুম কুসুম পেলবতার দেখা পাওয়া হলো না। তাতে অবশ্য আক্ষেপটুকু রয়েই যায়। তারপরও মোহময় যে পরিবেশের দেখা পেলাম, তার কোনো তুলনা হয় না। যেভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট, তাতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের অপরূপ ছটা। প্রকৃতি যে কত বড় চিত্রকর, সেটা পলে পলে অনুভব করতে থাকি। তার তুলির আঁচড়ে খোলতাই হতে থাকে জগতের রূপমাধুরী। দিনমণি সবে ডুবে গেছে। রয়ে গেছে তার মায়াবী আবেশ। চলতে থাকে আলো-ছায়ার অদ্ভুত খেলা। একটু একটু করে চারপাশে জমতে থাকে রক্তিম আভা। যেন কেউ মাখিয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো আবির। গগনজুড়ে বাঙময় হয়ে ওঠে তার লালিমা, তার লালিত্য, তার লাবণ্য। একাকার হয়ে যায় আকাশ, নদী আর প্রকৃতি। এর সম্মিলনে সৃষ্টি হয় মোহনীয় পরিবেশ।

গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে কমনীয় অন্ধকার। বৃক্ষগুলো হয়ে ওঠে প্রকৃতির ক্যানভাসের অংশ। নদীর তীরে অপেক্ষমাণ ছায়া ছায়া নৌকা। দাঁড়িয়ে থাকা মানব-মানবী রূপায়িত হয় ধূসর অবয়বে। আছে থোকা থোকা বিষণ্ণতাও। সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্যপটটি রূপ নেয় জলছবিতে। আঁখিপুটে যেন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে জলরঙের জাদুকর ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী যোষেফ উইলিয়াম টার্নারের এক একটি মাস্টারপিস। ক্যামেরায় তোলা ছবি দেখেও মনে হতে পারে কোনো চিত্রশিল্পীর ইজেলে আঁকা প্রকৃতির বিমূর্ত সব ছবি। তাতে আছে সুর-ছন্দ-কবিতার সংমিশ্রণ।

1কাব্যিক এ দৃশ্যপটটি মিলিয়ে যেতে না যেতেই অন্ধকারে ফুটে ওঠে আলোর বর্ণময় ফুটকি। দূর থেকে মনে হতে থাকে যেন দীপালি উৎসব। নদীর পানিতে তার প্রতিবিম্ব। কাঁপা কাঁপা রঙিন বিচ্ছুরণ। বইতে থাকে ঝিরি ঝিরি মাতাল হাওয়া। অপরূপ সেই নৈসর্গিক দৃশ্য। কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে নিভৃতে বসে আছেন কেউ কেউ। দূর থেকে ভেসে আসেন শ্রীকান্ত আচার্য: একা একা এই বেশ থাকা/আলো নেই কোথাও সব মেঘে ঢাকা/ছায়া ছায়া সব আবছায়া/যাকে খোঁজে মন তার নেই দেখা/আনমনে এই একা একা/সব মেঘে ঢাকা, সব মেঘে ঢাকা/আলো-ছায়া দিয়ে দিন চলে গেছে/আমাকে শূন্যতা দিয়ে গেছে/উতলা এক হাওয়া ভাসে/সে হাওয়ার সাথী/ শুধু নীরবতা, শুধু নীরবতা………। সন্ধ্যা নেমে এলে এমন দৃশ্যপট প্রতিনিয়ত দেখা যায় রাজশাহীর শহর রক্ষা বাঁধ বা টি-গ্রোয়েনে।

2দিনের বেলায়ও পদ্মা নদীর তীরের ঔজ্জ্বল্য কম দীপ্তিময় নয়। পাঠানপাড়া, লালন শাহ পার্ক, বড়কুঠির পর্যটন কেন্দ্রে রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালের মাধুর্য ও জৌলুশ বেশ উপভোগ্যময়। যদিও কার্তিকে গা বুলিয়ে দেওয়ার কথা মিঠের রোদের আমেজ। অথচ রোদের তেজের কারণে ঘেয়ে-নেয়ে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে। তারপরও বিস্তীর্ণ নদীর পাড় ঘেঁষে কাশফুলের নান্দনিক সমাহার মনের মধ্যে এনে দেয় শুভ্র পালকের ছোঁয়া। পাঠানপাড়ায় পরিত্যক্ত আমবাগানে সদ্য গড়ে ওঠেছে ‘সীমান্ত অবকাশ’, ‘সীমান্ত নোঙর’ নামের ক্যাফে ও রেস্তোরাঁ। আছে সুশোভিত পার্ক। গাছের তলায় চমৎকার বসার ব্যবস্থা। নির্জন। নিরিবিলি। কে যেন গুন গুন করে গাইছে, ‘আমার দিনগুলো সব রং চিনেছে তোমার কাছে এসে/শুধু তোমায় ভালোবেসে’। রোমান্টিক পরিবেশ। প্রেমপিয়াসীরা যাতে পাখির নীড়ের অনুভাব পেতে পারেন, সেজন্য পাকুড় গাছের উপর বেঁধে দেওয়া হয়েছে আচ্ছাদিত মাচা। এই ট্রি-হাউজে ‘নিভৃত নির্জন চারি ধার/দুজনে মুখোমুখি’ হয়ে ‘গভীর দুঃখে দুঃখি’ হওয়া যায় কিংবা হতে পারে ‘কেবল আঁখি দিয়ে/আঁখির সুধা পিয়ে’।

4বড়কুঠিতে গড়ে তোলা হয়েছে মহানগর উম্মুক্ত নাট্যমঞ্চ। অনেকটা প্রাচীন গ্রিসের অ্যাম্ফিথিয়েটারের মতো। প্রাকৃতিক আলোয় হতে পারে নাটকের আলোক প্রক্ষেপণ। আছে ‘পদ্মা ফুড গার্ডেন’। রঙিন ছাতা। পদ্মা নদীর তীরে পার্ক ছাড়াও গড়ে তোলা হয়েছে টাইলস দিয়ে হাঁটার দীর্ঘ পথ। আছে বসার চমৎকার সুব্যবস্থা। তপ্ত দুপুরকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন বয়সী মানুষের সমাগম। তবে স্কুল-কলেজ পালিয়ে আসা কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাই বেশি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদীর সুরতরঙ্গ। জুড়িয়ে দেয় মনপ্রাণ। চাইলে স্পিড বোট বা নৌকায় এক পাক ঘুরে আসা যায়। দূর থেকে দেখা যায় ভারতের মুর্শিদাবাদের প্রান্তরেখা। তবে খুব ভোরে কিংবা বিকেল হলে পদ্মা পাড়ের চেহারা আমূল বদলে যায়। সে সময় ঢল নামে মানুষের। জানা যায়, হাল আমলে পদ্মা নদীর তীরকে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রধান কারিগর রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। অবশ্য সৌন্দর্যকরণের এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে।
বরেন্দ্রভূমির গলার হার হয়ে যুগে যুগে শোভা বর্ধন করছে পদ্মা নদী। যদিও একসময়ের উত্তাল পদ্মা নদী হারিয়েছে তার যৌবন। খুব বেশি দিন পানির স্রোত থাকে না। শুষ্ক মৌসুমে বিশাল এলাকাজুড়ে চর পড়ে। তখন আর প্রমত্ত এই নদীকে চেনা যায় না। এই নদী অনেক মানুষকে নিঃস্ব করে দিলেও এর টান কিন্তু এড়ানো যায় না। পর্যটন কেন্দ্র ছাড়াও নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রকৃতির ছায়ায় মনোরম বাসভবন, সারদা পুলিশ একাডেমি, রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের মতো স্থাপনাগুলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।

5এই শহরে আছে গুরুত্বপূর্ণ বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর। বাংলাদেশের পুরানো জাদুঘরের একটি। প্রত্মতত্ত্ব সংগ্রহের দিক দিয়ে এটি বেশ সমৃদ্ধ। অনেক দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য নিদর্শন আছে। আছে সিন্ধু সভ্যতার গৃহস্থালি তৈজসপত্র। যা পাওয়া যায় মহেঞ্জোদারোতে। শিক্ষাদীক্ষায় শহরটি এগিয়ে আছে। দেশের অন্যতম একটি প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮২৮ সালে। সিল্ক সিটি হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর গৌরব ‘রাজশাহী সিল্ক’। দেশ-বিদেশে এর দারুণ কদর। বিসিক শিল্প নগরীতে রেশমের বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টরি ও শোরুম আছে। সেখানে রেশম চাষ থেকে শুরু করে শাড়ির প্রস্তুতপ্রণালী দেখা যায়। চাহিদা অনুযায়ী রেশমের যে কোনো পণ্য ক্রয় করা যায়।

6বাংলাদেশ ডাকবিভাগের রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এস এম তারিক কচির আমন্ত্রণে এবারই প্রথম সেখানে পা দিয়ে অনেক দিক দিয়ে ব্যতিক্রম মনে হলো রাজশাহী শহরটিকে। অনেকটা অনাঘ্রাতা নারীর মতো। এখনও বিভাগীয় এই শহরটির ক্ষত-বিক্ষত হয় নি। ইট-বালু-সিমেন্টের আস্তরের কাছে নিজেকে বিসর্জন দেয় নি। যে কারণে বহুতল ভবন খুব একটা দেখা যায় না। দেখা যায় না ডিজেলচালিত যানবাহন। ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সার প্রাধান্যই বেশি। গাড়িঘোড়ার দাপট দেখা যায় নি। লোকজনের চলাচলও খুব একটা চোখে পড়ে নি। তেমন ধুলোবালি নেই। দূষণ নেই। প্রবাহিত হয় নির্মল বায়ু। রাস্তা ঘাটগুলো ঢাকার চেয়েও উন্নত। এমনকি গলির মধ্যে রাস্তায়ও ভাঙাচুর নেই। শহরটা বেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। চারপাশে সবুজ বেষ্টনী। অসংখ্য গাছগাছালি। সবুজ ঘাস। টলটলে পুকুর আর দীঘি। কোথাও কোথাও কৃত্রিম হ্রদ। তবে আবহাওয়া সাংঘাতিক উত্তপ্ত। হেমন্তের শুরুতেও হিমেল হাওয়ার দেখা পাওয়া যায় নি। দিনের বেলা ঘরের বাইরে এলে বিভাবসু শরীরের রস একদম নিংড়ে নেয়।

7অথচ রাজশাহী অঞ্চল এমনিতে রসে টইটম্বুর। মিষ্টান্ন সামগ্রীর যথেষ্ট সুনাম আছে। তবে পুরো এলাকা ফলফলারি আর গাছগাছালিতে ভরপুর। কোথাও একটু বীজ পুঁতে দিলেই বেড়ে ওঠে রসালো ফল গাছ। তবে আম, লিচু, আখ, পেয়ারা, কলা গাছের উর্বরভূমি। রাজশাহী থেকে নাটোর যাওয়ার পথে রাস্তার দুই পাশে ফলফলারির বাগান। আছে ফল গবেষণাগার। দেখে মনে হয় সবুজের উপত্যকা। প্রাকৃতিক যে সম্পদ নিয়ে রাজশাহীর অবয়ব, সেটি অটুট রাখতে পারলে শহরটি যে কাউকেই বার বার কাছে টেনে নেবে। বাংলাদেশে এমন শহর ক্রমান্বয়ে দুর্লভ হয়ে ওঠছে।

Exit mobile version