রাঙামাটি থেকে: হাসি আর আনন্দের বদলে রাঙামাটির আশ্রয়কেন্দ্রে সহায়-সম্বল আর স্বজন হারা মানুষদের চোখে অশ্রু ঝরাচ্ছে ঈদের চাঁদ। পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ে কেউ কেউ আবার যেন এই চাঁদরাত্রে একেবারে অনুভূতি শূন্য। ঈদে কী খাবেন, কী পরবেন এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই নারীদের মধ্যে। আর পুরুষরাও বলতে পারলেন না সোমবার ঈদের নামায কোথায় পড়বেন। কারণ চেনা মসজিদটিও এখন পাহাড়ের ধসে পড়া মাটির নিচে।
রাঙামাটি সরকারি কলেজ, বাংলাদেশ টেলিভিশন কেন্দ্র, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, শিশু একাডেমিতে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অসহায় মানুষের মধ্যে সব মিলিয়ে এরকম শূন্যতা, অনিশ্চয়তার মিশ্র অনুভূতি।
আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা নাসিমা বললেন, এক শ’ টাকা সালামি চাওয়া ১০ বছরের ছেলেটাকে পাহাড় ধসের পর খুঁজে পাননি তিনি। আর এই ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে ৩ বছরের এক ছেলে আর গর্ভে থাকা ৪ মাসের সন্তানটিকে নিয়ে একেবারে পাথর হয়ে আছেন রেশমা।
ঈদে ছেলের নতুন জামা কিংবা নিজের শাড়ি পাওয়া না পাওয়ায় রেশমার কিছুই যায় আসে না। এখন তার একটাই জিজ্ঞাসা, ‘এহন যামু কই?’
পাহাড় ধসে মানবিক বিপর্যয়ে নাসিমা-রেশমাদের কাছে তাই ঈদে পোলাওয়ের চাল নেই, চুলা জ্বালানো, মশলা বাটার ব্যস্ততা এখন বিলাসিতা। তবুও বাচ্চাগুলোর মুখে ঈদে একটু ভালো খাবার দেয়ার আশায় তারা অপেক্ষায় আছেন কখন সেমাই কিংবা পোলাও নিয়ে আসবে আর্মির জিপ।
৩ ঘণ্টা মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা হনুফা এখন টেলিভিশন কেন্দ্রে আধশোয়া। তিনি বলেন, ‘এবার এমনে ঈদ করতে হবে কে জানতো?’ ঘর হারা নাসরিন আক্তারেরও এবার ঈদ ব্যস্ততা নেই। আশ্রয়কেন্দ্রের মেঝেতে তিনিও ছেলে কোলে বসে আছেন।
ভাবলেশহীন নাসরিনকে ঈদে কী রান্না করবেন জিজ্ঞেস করতে অনেকটা ব্যঙ্গ করেই বললেন, ‘চুলাই নাই আবার রান্না। গত ঈদে যে বাড়িতে পোলাও-মুরগি রান্না করলাম সেই বাড়ি এখন মাটির তলে।’
পরিবার নিয়ে টেলিভিশন কেন্দ্রের একটি কক্ষে আশ্রয় পাওয়া অমর বালা চাকমা বলেন, ‘আমরাও ঈদের জন্য পিনন-থামি পেয়েছি।’
টেলিভিশন কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত ৮৫টি পরিবার। এর মধ্যে ১২ টি চাকমা পরিবার, আর বাকি সবাই বাঙালি। এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে ভেদভেদী উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে আছে ১০১ টি পরিবার। তবে এখানকার মানুষগুলোর বেশভূষা অন্যান্য আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কিছুটা যেন আলাদা। অল্প বয়সী নারীদের পোশাকই বলে দেয় এরা একেবারে দরিদ্র ছিল না। পাহাড় ধসে ঘর-বাড়ি হারিয়ে আজ নিতান্ত বাধ্য হয়েই তারা উঠেছেন এখানে।
রাঙামাটি সরকারি কলেজের বাইরে বাজার বসেছে, সেখানে স্বাভাবিক চিত্র। সেই ভিড় এড়িয়ে কলেজের ভেতর ঢুকতেই পাহাড় ধসের ক্ষতগুলোর তীব্রতা স্পষ্ট হলো বারান্দায় লাইন ধরে খাবার নিতে আসা মানুষগুলোকে দেখে। থালা, বাটি, মগ হাতে ভাতের জন্য দাঁড়িয়েছে তারা। দুই নাতনীকে চাচার জিম্মায় রেখে লাইনে দাঁড়িয়েছেন ৭ বছরের মীম আর ১৭ মাস বয়সী সুমাইয়ার দাদী।
কাছেই একটি কক্ষে চাচার সঙ্গে পাটিতে বসে ভাতের অপেক্ষায় অবুঝ মীম-সুমাইয়া। বাবা-মা হারানো এই দুই শিশুর আপাতত আশ্রয় এই কলেজ ক্যাম্প থেকে আশ্রয় জুটবে চাচার বাড়িতে।
ওই শিশুদের চাচা কাউসার জানান, ‘ভাই-ভাবি থাকতেন রাঙামাটির রূপনগরে। এখন সবই মাটি চাপা পড়েছে। তারা দুই মেয়েকে রেখে গেলেন। আশ্রয় কেন্দ্রে মেয়ে দুটি আজ নতুন জামা পেয়েছে।’
শহরের রিজার্ভ বাজারের কাছেই শিশু একাডেমির আশ্রয়কেন্দ্র। এখানে আশ্রয় নেয়া ১২টি পরিবারের সবাই বাঙালি। অন্য আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর মত এখানে স্বজন হারানো মানুষ তেমন নেই। তবে সহায়-সম্বল হারানো খালেদা বেগম জানেন না কাল ঈদের দিন কী হবে।
তিনি জানালেন, ‘সরকারের লোকেরা ঈদের দিন ভালো খাবার দেবে এই একমাত্র ভরসা।’আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বাবর-সোহেলরা জানান, ‘এখানে কাল রান্না হবে না। রান্নার সুযোগ নেই। শুধু ঈদের নামায মসজিদে পড়া যাবে এটা নিশ্চিত হয়েছি।’
এসব আশ্রয়কেন্দ্রে চাঁদরাতে কিছুটা হলেও ঈদের আমেজ নিয়ে হাজির হয় শাড়ি,পাঞ্জাবি, লুঙ্গি নিয়ে আসা ত্রাণবাহী গাড়ি। জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে আশ্রয় নেয়া মানুষদের মাঝে আজ ঈদ উপলক্ষে এসব বিতরণ করা হয়।
আশ্রয়কেন্দ্রে জেলা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর মানবিক সহায়তার পাশাপাশি জরুরি দায়িত্বে আছে পুলিশ ও বিজিবি।
পাহাড় ধসের পর থেকে সেখানে টানা দায়িত্ব পালন করছেন সেনাবাহিনীর ২০ বীর ব্যাটালিয়নের সদস্য আকমল, হায়দাররা। সেনাদের সহায়তা করতে ক্যাম্পগুলোতে আছে ৪-৫ জনের স্বেচ্ছাসেবক দল।
রাঙামাটি ও চট্টগ্রামের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা দিনরাত বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করছেন এসব আশ্রয়কেন্দ্রে। তাই ইমরান, জোবায়ের, রূপারাও কাল ঈদের দিনে থাকবেন এসব অসহায় মানুষের পাশে।
ঈদে নিজেদের বাড়িতে না থেকে এই অসহায় মানুষদের কিছুটা ঈদ আমেজ দিতে পারায় সন্তুষ্ট তারা।
ছবি: নাসিমুল শুভ