সমাজের সব জটিল সমস্যাগুলোর, সে জিন-পরিবর্তিত খাদ্যই হোক বা পরমাণু বিদ্যুৎই হোক আর ধর্মের জন্য জিহাদই হোক, সমাধান করতে হবে যুক্তি-তর্ক- বিশ্লেষণের পথে। এর জন্য প্রয়োজন যথাযথ বিতর্ক আর সমস্যাটি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান। আবেগ-বিশ্বাস- ভয় দিয়ে জটিল সমস্যার নিষ্পত্তি হবে না। শুধু স্কুল-কলেজ নয়, বাড়ি-কর্মস্থল- পাড়া সর্বত্র যুক্তি তথা বিজ্ঞানের প্রসারে বিনিয়োগ করতে হবে। যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে।
এই কথাগুলো বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময় নানাজনের মুখে শোনা গছে। কিন্তু এই কথাগুলোকে কী আমরা আদৌ গুরুত্ব দিয়েছি? আমাদের সমাজের বর্তমান অবক্ষয় থেকে রেহাই পেতে যুক্তিবাদী হওয়া বা যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তোলার বিষয়টি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ-এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। তারপরও আমরা যুক্তিবাদী হচ্ছি না বা যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তোলার ব্যাপারে খুব একটা ভূমিকা পালন করছি না! কারণ কী? কারণ যুক্তিবাদী হওয়া বা যুক্তিবাদী প্রজন্ম গড়ে তোলার কাজটি কঠিন। এর জন্য আমাদের বইমুখী হতে হবে। জ্ঞান চর্চা বাড়াতে হবে। জানতে হবে, বুঝতে হবে। জানানোর পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এই কষ্টকর ও কঠিন কাজটি আমরা কেউই করতে চাইনা।
আমরা প্রচলিত স্রোতে গা-ভাসিয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত। যেখানে চ্যালেঞ্জ আছে, কষ্ট আছে, অধ্যাবসায়ের ব্যাপার আছে, সেটা আমরা করতে চাই না। অথচ এই কাজটিই বর্তমানে সবচেয়ে জরুরি এবং অগ্রাধিকার হওয়া দরকার।
ষোল কোটি মানুষের যে দেশে রাজনৈতিক নির্বাচন ব্যবস্থাটি চলে আবেগ-বিশ্বাস- ভয় দিয়ে, যে দেশের বহু মানুষের এখনও কবজ-তাবিজ- পাথরের অলৌকিক ক্ষমতায় তর্কাতীত বিশ্বাস, সেখানে এমন যুক্তির কথা খুব জরুরি। যাঁরা যুক্তির পথে থাকতে পারেন, তাঁরা সাহসী। আমরা উৎপল দত্তের ডিরোজিয়ো নাটকে দেখি, যুক্তির কথায় একজন ক্ষমতাবান লোক রেগে গিয়ে ডিরোজিয়োকে চড় মারল। তাঁর শিষ্যরা প্রত্যাঘাত করতে তৈরি। ডিরোজিয়ো দুহাত তুলে ওদের থামতে বলে, লোকটির উদ্দেশ্যে মৃদু হেসে বললেন, এতে কী প্রমাণিত হল? আপনি এক জন গুন্ডা, যুক্তিবাদী নন!
আমাদের মধ্যে বর্তমানে যুক্তি-জ্ঞান- বিজ্ঞান চর্চার সীমাহীন ঘাটতি রয়েছে। অথচ এগুলো ছাড়া সমাজকে এগিয়ে অসম্ভব। আজ থেকে প্রায় পঁচাত্তর বছর আগে সাহিত্যিক রাজশেখর বসু লিখেছিলেন, ‘যিনি বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবক, তিনি ধীর ভাবে ভ্রমপ্রমাদ যথাসাধ্য পরিহার করে সত্যের সন্ধান করেন, প্রবাদকে প্রমাণ মনে করেন না, প্রচুর প্রমাণ না পেলে কোনও নূতন সিদ্ধান্ত মানেন না, অন্য বিজ্ঞানীর ভিন্ন মত থাকলে অসহিষ্ণু হন না, এবং সুপ্রচলিত মতও অন্ধ ভাবে আঁকড়ে থাকেন না, উপযুক্ত প্রমাণ পেলেই বিনা দ্বিধায় মত বদলাতে পারেন। জগতের শিক্ষিত জন যদি সকল ক্ষেত্রে এই প্রকার উদার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি প্রয়োগ করতে শেখেন, তবে কেবল সাধারণ ভ্রান্ত সংস্কার দূর হবে না, ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক সংঘর্ষেরও অবসান হবে।’
আর এক চিন্তাবিদ রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বৈজ্ঞানিক চিন্তার সমর্থনে বলছেন, ‘কোন একটা ঘটনার খবর পাইলে সেই খবরটা প্রকৃত কিনা এবং ঘটনাটা প্রকৃত কিনা তাহা জানিবার অধিকার বিজ্ঞানবিদের প্রচুর পরিমাণে আছে। এই অনুসন্ধান কার্যই বোধ করি তাঁর প্রধান কার্য। প্রকৃত তথ্য নির্ণয়ের জন্য তাঁহাকে প্রচুর পরিশ্রম করিতে হয়।… অবৈজ্ঞানিকের বিজ্ঞানবিদের এইখানে পার্থক্য।’
সুকুমার রায় লিখছেন, ‘কতগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে তখন তাহার প্রভাব কত দূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সবচাইতে বড় দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ। এতবড় সর্বগ্রাসী জুজু এ দেশে বা কোনো দেশে আর দ্বিতীয় নাই।… যে সত্যকে সত্যরূপে দেখিতে গেলে মানুষের পৌরুষবুদ্ধিকে খোয়াইতে হয়, তবে সে সত্যবঞ্চিত অক্ষম পৌরুষ আমার কোন কর্মে লাগিবে?’
রামমোহন-ডিরোজিয়ো থেকে বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথ- সত্যেন্দ্রনাথ বসু-ড. মোহান্মদ শহীদুল্লাহ – মোতাহের হোসেন চৌধুরী-আবদুল ওদুদ প্রমুখ ব্যক্তিরা সবাই অন্ধতা, অযুক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন।
চীনের অবিসংবাদিত নেতা কমরেড মাও সে তুং ও বলেছিলেন, শত ফুল ফুটুক, শত মতাদর্শ দ্বন্দ্বে মাতুক। অর্থাৎ তিনি বিভিন্ন রকমের মতাদর্শের তর্ককে আবাহন করেছেন। বলেছেন, এর থেকেই সত্য বেরিয়ে আসবে। সঠিক মতাদর্শকে আড়াল-আবডাল করে রাখার দরকার নেই। তাকে ছেড়ে দাও বিভিন্ন মতাদর্শের মুখে। এদের সঙ্গে যুক্তির লড়াইয়ে সঠিক মতাদর্শটি, প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের পর, আরও পোড় খেয়ে সত্য হয়ে ফুটবে। কিন্তু আমরা আজ যুক্তিহীন আবেগ, গুজব ও বিশ্বাসনির্ভর এক প্রজন্ম লক্ষ করছি। কারও মধ্যে যুক্তির চর্চা নেই, জ্ঞান আহরণের আকাঙ্ক্ষা নেই, চিন্তার চর্চা নেই। তাইতো এখন মানুষ সহজেই মৌলবাদী হচ্ছে। জঙ্গি হচ্ছে। কেউ কোনো কিছু যুক্তি দিয়ে, বুদ্ধি-বিবেচনা- চিন্তা দিয়ে গ্রহণ করতে চাইছে না। গ্রহণ করতে পারছে না। যুক্তি-তর্ক- চিন্তাহীন আমাদের বেড়ে উঠা, বেঁচে থাকা।
আমাদের লেখাপড়া নেই। জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষা নেই। তাগিদও নেই। সবাই যেন স্রোতে ভাসা শ্যাওলা। তাইতো সমাজে অবক্ষয় বাড়ছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। বাড়ছে বিদ্বেষ আর সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাস! যথাযথ সুশৃঙ্খল তর্কবিতর্ক (স্ট্রাকচারড ডিবেট) চালাতে গেলে দুই পক্ষকেই সহিষ্ণু হতে হয়। বিদ্যাবিুদ্ধি লাগে। জানতে হয়। পড়তে হয়। গোলমালটা এখানেই। গত চার দশক, বিশেষত বিগত এক দশকে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস হল অসহিষ্ণুতার ইতিহাস। যে যখন ক্ষমতায়, বিরুদ্ধ যুক্তি শুনতে চায় না। বিরোধী মানেই যেন দেশের শত্রু, প্রতিক্রিয়ার শক্তি!ক্ষমতাসীনরা মনে করে বিরোধীরা আমাদের তুলনায় নগণ্য, অতএব ওদের কথা শোনার দরকার নেই।
এটা শুধু রাজনৈতিক পরিমন্ডল তথা ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলের ব্যাপার নয়, পুরো সমাজ জুড়েই একই চিত্র। কেউ কারো কথা বা মত সহ্য করতে পারে না। বিরুদ্ধ মত শোনায় কেন এত অনীহা? যুক্তি দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপনে কেন এই দৈন্য? ক্ষমতাসীনরা মাঝে মাঝে এমন ভাব দেখান যেন তাদের রাজনীতিই রাষ্ট্রের রাজনীতি। বাকি সব প্রতিক্রিয়া। এই অসহিষ্ণুতাকে সরিয়ে ‘যথাযথ বিতর্ক’-কে সম্মান দিতে না পারলে আমরা রসাতলে যেতে বাধ্য। সমাজে যুক্তিবাদ যদি প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে আমরা যুক্তির নিরিখে বুঝতে শিখব পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের পক্ষে ভালো না খারাপ? অথবা জিন-পরিবর্তিত খাদ্য এই স্বাস্থ্য-বিপন্ন দেশবাসীর ওপর আর একটি অভিশাপ না আশীর্বাদ? আমরা বুঝতে শিখব, বিভিন্ন সেবামূলক খাতে বিদেশি বিনিয়োগে দেশের লাভ না ক্ষতি? পরিবহণ ব্যবস্থা সচল রাখতে কেনই বা ভাড়াবৃদ্ধি জরুরি? কিন্তু ওই পরমতসহিষ্ণু আবহাওয়া গড়ে উঠবে কী ভাবে?
প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের প্রশ্নটি যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করা জরুরি। অন্ধবিশ্বাস, অভ্যাস জিজ্ঞাসার পরম শত্রু। মানুষ যাতে অভ্যস্ত হয়, সে সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে ভুলে যায়। যা আছে, তাকেই বিনা প্রশ্নে, বিনা তর্কে স্বাভাবিক, অমোঘ, এমনকী শাশ্বত বলে ধরে নেয়।
যুক্তি মহাশূন্যে ভেসে থাকতে পারে না, তাকে বাস্তবের কঠিন ভূমিতে পথ কেটে চলতে হয়। ধর্মের যুক্তি আমাদের আত্মঘাতী-নৃশংস জঙ্গি হতে শেখায় কি-না সেটাও যুক্তিবাদই পারে সমাধানে পৌঁছাতে। এ জন্যও যুক্তি ও জ্ঞানসাধনা জরুরি।
সময়টা বর্তমানে যুক্তিহীন স্বার্থপরতার ও আত্মকেন্দ্রিকতার।মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের। এর পেছনে রাজনীতির প্রভাবও কোনো অংশে কম নয়, যেমন অতীত ঐতিহ্যের প্রভাবে, তেমনি বর্তমানের বিষয়বুদ্ধির বিচারে। তবে মূল কারণটা সংকীর্ণ ধর্মীয় চেতনার, যে জন্য সংবিধান থেকে
ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত হতে পেরেছে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমাজকে আলোকিত করতে পারে না, যদি সেখানে আধুনিকতা ও আদর্শবাদের আলো না জ্বলে। যদি যুক্তি ও বুদ্ধি একাত্ম না হয়। সেই না হওয়ার সমস্যাটাই বাংলাদেশি সমাজে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সংকট থেকে মুক্তি বাংলাদেশি সমাজের জন্য অপরিহার্য, বিশেষ করে যে ‘মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে।’ বিষয়টি নিয়ে ভাবনার খুবই দরকার আছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)