মেয়ে তোমার নাম কী? তুমি কি জয়ী? তুমি কি প্রীতিলতা? তুমি কি সুলতানা রাজিয়া? নাকি তুমি ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই? নাকি মাতঙ্গিনী হাজেরা? তুমি যেই হও তুমি আমাদের মেয়েদের সাহস দেখনোর বাতিঘর। তোমার নাম দিলাম নির্ভীক। তোমার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নারীরা নির্ভীকভাবে পথে কাজ করুক, রাতে দিনে, যেকোন সময়ে, তোমার দেখানো পথে হেঁটে যাক আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে। তুমি যেই হও তোমায় সালাম। তুমি আমাদের হয়ে প্রশাসনের একদল রক্ষকরূপী হায়েনার সামনে যা করেছো একা, একদম একা ভোর রাতে, ওদের তুলে ধরেছো সমাজের কাছে, এরা নারীদের একা পেলে কী কথা বলে, কী আচরণ করে তা প্রকাশ হয়েছে। তারা কতটা খারাপ কাজ করতে পারে নারী বা নাবালিকা মেয়েদের একা পেলে, তার উদাহরণ ইয়াসমিনসহ নাম জানা ও অজানা অনেক মেয়ে।
জানিনা তুমি কেমন করে এই নরপিশাচগুলোর মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে জবাব দিলে। তোমার, আমার নাগরিক অধিকার কী তা বুঝিয়ে দিলে। তুমি যেন অন্ধকার রাতে গনগনে এক তেজীয়ান সূর্য, তোমার তেজে হার মেনেছে একদল পশু। জানি না ওই রাতের পর তোমার কী খবর? কেমন আছো কোথায় আছো? ওরা কি তোমায় পরে হয়রানি করেছিল বা করছে কিনা জানি না।
সেদিন রাতের ভিডিওটা বার বার দেখেছি, দেখেছি তুমি কিভাবে ঋজুতায়, সাবলীলভাবে ওদের প্রতিটি বাজে কথার উত্তর করছিলে। চমৎকৃত হয়েছি। দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করতে যেয়ে হাজার বার রাতে বাড়ি ফিরতে হয়েছে, বাজে উক্তি পুলিশ, দোকানদার, রিকশাওয়ালা, ভদ্র পোশাকে আচ্ছাদিত পুরুষ, কিশোর, যুবক, দাড়িওয়ালা, টুপিওয়ালা অনেকের তির্যক কথা শুনেছি। প্রথম প্রথম উত্তর দিলেও এদের নোংরা কথা যখন মাত্রা ছাড়িয়েছে বাধ্য হয়েছি চুপ করে সরে আসতে। তবে হাতে ক্যামেরা থাকলে কোন ঝামেলা হয়নি। যাদের কাছে আশা করিনি সেই প্রান্তিক মানুষের ভালবাসা পেয়েছি, তাদের সহযোগিতা পেয়েছি কাজের বিভিন্ন সময়ে।
নারীর নিরাপত্তা কোথায়? যাদের সামনে পেলে বুকে বল বাড়ার কথা, যাদের দেখলে সব ভয়-ডর উড়ে যাবার কথা, যারা বিপদে সহায় হবার কথা, তাদের দেখলেই কেন সাধারণ মানুষের আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে উড়ে যেতে চায় আতঙ্কে? আতঙ্ক সৃষ্টিকারী কোন ভয়ংকর পশু নয়, তারা পুলিশ। বলা হয়ে থাকে পুলিশ ছুঁলে আঠারো দুগুণে ছত্রিশ ঘা। একদল পুলিশের লালসা ও লোভের কাছে তাবৎ পুলিশ সমাজ কলঙ্কিত। কারণ অপরাধী পুলিশদের শাস্তির নামে লোক দেখানো ক্লোজ করা হয়ে থাকে। ক্লোজার কি কোন শাস্তি হলো? ডিজিটাল আইনে অসম্মানজনক কথা বলা, অপমান করা তো ফৌজদারী অপরাধের মধ্যে পড়ে। অসম্মানজনক কথা বললে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের মত ব্যক্তিকে যদি জেল হাজতে প্রেরণ করা যায়, তাহলে এতো এতো বাজে কথার জন্য এই পুলিশগুলোর তো যাব্বজীবন কারাদণ্ড হতে পারে।
আমাদের সমাজে নারীকে নিচুতলার মানুষ মনে করা হয়, এই কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষ-যুবক-বালক নির্দ্বিধায় অসম্মানজনক কথা বলে ও আচরণ করে। মেয়েদের ঘায়েল করতে পুরুষ তার চরিত্র নিয়ে কথা বলে।
চরিত্র আসলে কী? এর মানদণ্ড কী? এর পরিমাপকই বা কী? কী কী করলে চরিত্র হারায়? যে কাজ করলে পুরুষের কপালে জোটে প্রশংসা, সেই একই কাজ নারী করলে হয় চরিত্রহীন। লেখাপড়ায় ভাল হলে মেয়েদের চরিত্র খারাপ হয়, কারণ ভালো মার্কস মেয়েরা মেধার জোরে পায় না বলে পুরুষী চিন্তা। মেয়েটি শার্ট প্যান্ট পরে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়েটি ছেলেদের সাথে হেসে হেসে কথা বলে তো চরিত্র খারাপ, মেয়েটির অনেক ছেলে বন্ধু তো মেয়েটির চরিত্র খারাপ, মেয়েকে বসের সাথে অনেক সময় ধরে কাজ করতে হয়, তো মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়ে গার্মেন্টস রিলেটেড কাজ করে, মেয়েটি বায়ার হ্যান্ডেল করে মেয়ের তো চরিত্র খারাপ। মেয়েটি রাতে ফেরে কাজ থেকে তাই মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়েটি সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তো মেয়েটির চরিত্র খারাপ, মেয়েটি প্রেম করে তো চরিত্র খারাপ।
মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়ে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ। মেয়ে মাথায় কাপড় দেয় না তো চরিত্র খারাপ, মেয়ে উচ্চস্বরে হাসে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়ে কাজে প্রমোশন হয়েছে তো তার চরিত্র খারাপ। মেয়ে নাচগান করে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ, মেয়ে সাইকেল চালায় মেয়ে খারাপ, মেয়ে নাটক-সিনেমা করে তো তার চরিত্র খারাপ, মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে তো মেয়ের চরিত্র খারাপ। বড়লোকের মেয়ে তো চরিত্র খারাপ, দরিদ্রের মেয়ে তো চরিত্র খারাপ। তুমি মেয়ে সেই চরিত্রের মুখে জুতার বাড়ি মেরেছো। অভব্য, অসভ্য, নোংরা মন্তব্যকারী পুলিশগুলোর প্রতিটা কথার জবাব মুগ্ধ করেছে গো মেয়ে। তোমার জন্য এক আকাশ ভালবাসা।
নারীর প্রতি বস্তাপঁচা ধারণা কবে নাগাদ পরিবর্তন হবে জানি না কিন্তু জানি তোমাদের মত মেয়েরা অন্যায়ের কড়া জবাব দিচ্ছে। নারীরা ধীরে হলেও নিজেদের পরিবর্তন ডেকে আনছে। পুলিশগুলো তোমায় ভিডিও করেছিল তোমার মানহানির চেষ্টায়, তোমায় হেনস্তাকারীদের নামে তুমি মামলা কর। স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাদের পাশে আছেন, উনি নিশ্চয়ই দেখবেন বাকিটা। তুমি মামলা কর, অন্য কেউ হয়ত তোমার হয়ে করবে না। কারণ তুমি সাধারণ মেয়ে, তোমার নেই ক্ষমতাবান বন্ধু বা আত্মীয় বা দল। তুমি আমাদের প্রতিনিধি হয়ে মামলা কর। তুমি প্রমাণ করেছো তোমার সৎ সাহসের, আর পুলিশ, যাদের দেবার কথা ছিল তোমার নিরাপত্তা, ভরসা ও সাহস, তারা বিপরীত কাজ করে নিজেদের চরিত্রহীন প্রমাণ করেছে। কিছু চরিত্রহীন পুলিশের কারণে গোটা পুলিশ সমাজ আজ নিজেদের চরিত্র নিয়ে বিপাকে, সাধারণ মানুষসহ অধিকাংশ মানুষ পুলিশকে বিশ্বাস করে না, ভয় পায়, আতঙ্কিত হয়। পুলিশ প্রশাসনের ভাবা উচিত নিজেদের ভাবমূর্তি নিয়ে।
তোমায় একটা কথা বলি শোন নির্ভীক মেয়ে, বিভিন্ন সময় অনেকে আমাকে বলেছে আমার মেয়েটি যেন আপনার মত নির্ভীক, ডানপিটে হয়, মুখের উপর উচিত কথা বলে দিতে শেখে। আজ আমি চাই, আমার মেয়ে দুটো যেন তোমার মত নির্ভীক, উদ্ধত হয়, আর শেখে বলতে উচিত কথা মুখের উপর তোমার খোঁজ চাইছি, একটা আলিঙ্গনের অভিপ্রায়ে। নির্ভীক মেয়ে তুমি এমনই চরিত্রহীন থাকো, বদলে যেও না আমাদের মত। তোমায় সৎ সাহসের জন্য জানাই ভালবাসা আর ভালবাসা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)