এক সময়ের নদী ভাঙনে অসহায় মানুষের আহাকার আর বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে জিম্মি লক্ষ্মীপুরবাসীর জীবনে গত একদশকে এসে অনেকটা স্বস্তির ছায়া। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পে নদী ভাঙন যেমন নিয়ন্ত্রিত ঠিক তেমনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থানে সন্ত্রাস এখন অপরিচিত নাম।
বদলে যাওয়া লক্ষ্মীপুরবাসী এখন মশগুল নির্বাচনী আমেজে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও উৎসবের নগরীতে পরিণত দেশের দক্ষিণ পূর্বাংশে উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। মেঘনা নদী বিধৌত এ জেলা এক সময়ের বিএনপির শক্ত ঘাটি হিসেবে পরিচিতি পেলেও বর্তমানে সেখানকার ৪টি সংসদীয় আসনেই রয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মহাজোটের সংসদ সদস্য।
গত দশ বছরে জেলার রাজনীতিতে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। উন্নয়ন এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সংগঠনিক ভাবে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে সংগঠনিক ভাবে শক্ত অবস্থানে আওয়ামী লীগ।
অবশ্য অতীতে বিএনপির ঘাটি বলে লক্ষ্মীপুর যে পরিচিতি পেয়েছিলো তা মানতে নারাজ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলছেন: লক্ষ্মীপুর কখনই বিএনপির ঘাঁটি ছিলো না। এখানে সব সময়ই আওয়ামী লীগের ভোট বেশি ছিলো। কিন্তু ভুয়া ভোটার তালিকা করে বরাবরই ভোটের রাজনীতিতে পেছনে ফেলেছে আওয়ামী লীগকে। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। নতুন ভোটার তালিকার পর ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ভোট বাক্স ভারি করার বিএনপির রাজনৈতিক অপকৌশল শেষ হয়ে গেছে।
বিএনপি সব সময় বিভিন্ন নামে গড়ে ওঠা সন্ত্রাসী সংগঠন দিয়ে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রাখতো। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেটা থেকে লক্ষ্মীপুরের মানুষ মুক্তি পেয়েছে বলে যোগ করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. নূর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ থেকে নিজেদের ঐক্য ধরে রাখাই আওয়ামী লীগের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ তখন লক্ষ্মীপুর সদর-৩ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন প্রায় হাফ ডজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। এদের মধ্যে রাজনীতিবীদদের সঙ্গে রয়েছেন ব্যবসায়ীরাও। প্রত্যেকেরই প্রত্যাশা জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি তাকে বেছে নেন তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদের্শ আগামী দিনে লক্ষীপুরের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। একই সঙ্গে শক্তিশালী করবেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাণ্ডারী শেখ হাসিনার হাতকে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রচারে তোড়জোড় থাকলেও প্রত্যেকেই অবশ্য বলছেন দল যাবে বেছে নেবে তার পক্ষেই নির্বাচন করতে প্রস্তুত তারা। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে বাইরে কেউ যাবেন না। এদিকে জেলা আওয়ামী লীগ থেকে জানানো হচ্ছে: কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কেন্দ্রীয় নেতা এবং সংস্থা লক্ষ্মীপুরের রাজনীতির খবর নিলেও আনুষ্ঠানিক ভাবে এখনো জেলার চার আসনে প্রার্থীর তালিকা চাওয়া হয়নি। কেন্দ্র যাকে মনোনীত করবে তার হয়েই কাজ করতে প্রস্তুত জেলা আওয়ামী লীগ।
৭৩ এ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর সদর-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বর্তমান সরকারের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী শাহজাহান কামাল। এরপর কেটে গেছে প্রায় ৪০ বছর। এ সময়ে আওয়ামী লীগের কেউ এ আসনে আর নির্বাচিত হতে পারেননি। শেষ ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শাহজাহান কামাল। বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রীর পদে রয়েছেন তিনি।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক করা শাহজাহান কামালে রাজনৈতিক অঙ্গণে বিচরণ প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি সময়। শেষ বেলায় আবারও মনোনয়ন চাইবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের এ প্রবীণ নেতা বলেন: আমি আজ থেকে রাজনীতি করি না। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে আমি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। এবার সরকারের মন্ত্রী হয়েছি। এলাকার যথেষ্ট উন্নয়ন করেছি। সব বিবেচনায় আমি আবারও মনোনয়ন চাইবো।
দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া না হলে দলের মনোনিত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে থাকবেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছি। এখন মনোনয়ন না পেলে কী করবো সে প্রশ্নের জবাব দিতে হবে!
মনোনয়নের দৌড়ে এ আসনে শাহজাহান কামালকে পেছনে ফেলতে জনসংযোগ করে যাচ্ছেন লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাওয়া সজীব করপোরেশনের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, কারিগরি শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি ও ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুস সাত্তার এবং লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক, ডেলিকেট গ্রুপের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন।
দলের স্বার্থে অতীতের ত্যাগ বিচেনায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গোলাম ফারুক পিংকুকে বেছে নেবেন বলে করেন তিনি। বলেন: ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর নেমে আসা অসহনীয় দুর্ভোগে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগকে আগলে রেখেছিলেন তিনি। শুধু সদর আসন নয় পুরো জেলার ৫৮টি ইউনিয়ন পরিষদে রয়েছে সাংগঠনিক বিচরণ। অতীতের ত্যাগ এবং তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ বিবেচনায় তাকে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে বলে বিশ্বাস করেন তিনি।
অন্যদিকে এম এ হাশেম বলছেন, লক্ষ্মীপুর সদর আসনে নৌকাকে বিজয়ী দেখতে চাইলে তার বিকল্প নেই। কেননা, ৭৫ পরবর্তী সময়ে লক্ষ্মীপুরের ইতিহাসে বিএনপি প্রার্থীর বিরূদ্ধে সর্বোচ্চ প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা নৌকার প্রার্থী তিনি। ২০০৮ সালে অল্প ব্যববধানে হারার কারণ হিসেবে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগে অন্তঃকোন্দলকে বড় করে দেখেন। ২০১৪’র নির্বাচনে শারীরিক অসুস্থতার কারণে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ানো হাশেম এখন অনেকটা নির্ভার। ছেলেদের ওপর ব্যবসার সকল দায়িত্ব দিয়ে রাজনীতিতে সময় দিতে প্রস্তুত রয়েছেন বলে জানান এ সফল ব্যবসায়ী।
লক্ষ্মীপুরে সমাজ সেবা এবং জনহিতকর কাজে হাশেম এবং তার পরিবারের দীর্ঘ ৭৫ বছরের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, আমি বিশ্বাস করি আগের যে কোন সময়ের তুলনায় আওয়ামী লীগ এখন আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ। তাকে যদি মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা তাকে সহজেই ভোটের বৈতরণী পার করাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আবদুস সাত্তার জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন ঢাকা শহরে। দেশের কারিগরি শিক্ষাকে প্রতিষ্ঠিত করা এবং ছড়িয়ে দেওয়াতে রয়েছে যার অগ্রণী ভূমিকা। শিক্ষাকে পেশা হিসেবে নেওয়া সাত্তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট’ সফল ভাবে পরিচালনার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীর্ঘ দিন থেকে জড়িত রয়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। বর্তমানে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি বড় একটি সময় দিচ্ছেন নিজে জন্মভূমি লক্ষ্মীপুরে। কাজ করছেন জেলা আওয়ামী লীগের হয়েও।
নিজ উদ্যেগে এবং সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে ‘অধ্যক্ষ এম এ সাত্তার ট্রাস্ট’র মাধ্যমে লক্ষ্মীপুরের অসহায় দরিদ্রদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন সহায়তার হাত। সমাজের অবহেলিত মানুষকে সচেতন করে তুলে সরকারের উন্নয়নের বার্তা গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাইছেন তিনি। তার এ কাজকে আরও এগিয়ে নিতে এবং শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকে বেছে নেবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যান্যের মধ্যে তরুণ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায় বিষয় উপকমিটির সদস্য দেলোয়ার হোসেন প্রত্যাশা করছেন তারুণ্য, জনসম্পৃক্ততা এবং গ্রহণযোগ্যতার বিচারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাকেই বেছে নেবে। বলছেন: ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্যদিয়ে আমার রাজনীতিতে হাতে খড়ি। এরপর প্রায় অর্ধযুগের মতো সময় আমি লক্ষ্মীপুরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছি। এ সময়ে জনস্বার্থে নিজ অর্থ ব্যয় বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের কাজ আমি করেছি। আমি মনে করি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যদি আমাকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে এলাকার উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নত বাংলাদেশ গড়ায় দৃঢ় ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবো।
নিজ দলের পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের ভোটও আওয়ামী লীগের ভোট বাক্সে নিয়ে আসার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী তরুণ এ নেতা। মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী থাকলেও দল যদি অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয় তাহলে তার পক্ষে কাজ করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন তিনি। বলেন: মনোনয়ন না পেলেও দেশের উন্নয়নের স্বার্থে এবং বর্তমান সরকারের গৃহীত মেগা প্রজেক্ট গুলো এগিয়ে নিতে আওয়ামী লীগের জয়ের বিকল্প নেই। তাই যেই মনোনয়ন পাক না কোন তার জয়ের জন্য কাজ করবো।
তথ্য সহযোগিতায়: মহিউদ্দিন মুরাদ, লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি।