৫, সেগুনবাগিচার ছোট্ট দোতলা বাড়ি থেকে এবছর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিজের ভবন পেয়েছে। মুক্তি সংগ্রামের ছাপে তৈরি আগারগাঁওয়ের এই স্থাপনায় স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহ-স্মারক। মুক্তিযুদ্ধ না দেখা সাধারণ দর্শনার্থী থেকে শুরু করে মনে ৭১-এর জ্বলজ্বলে স্মৃতি বয়ে বেড়ানো মুক্তিযোদ্ধারাও আসেন এখানে।
জাদুঘর ভবনের চতুর্থ, পঞ্চমতলা ঘুরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকারের গঠন, ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প, দেশজুড়ে চলা পাকিস্তানি পিশাচদের হত্যা, ধর্ষণ এবং তাদের আগুনে পোড়া সাজানো সংসারের কয়েকটি পোড়া তক্তায় একাত্তরের দিনগুলিতে ফিরে যান মুক্তিযোদ্ধারা। জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে ছোট ছোট বাক্যে জাতির বীর সন্তানরা লিখে যান মুক্তিযুদ্ধের মর্মকথা।
জাদুঘরের সংগ্রহে নিজেদের বাড়ির খাটের পোড়া তক্তা এবং নিজের ও সহযোদ্ধাদের ছবি দিয়েছেন কেরানীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান খান। ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে এইসব স্মৃতির দিকে তাকিয়ে তিনি আবারও যেনো ফিরে গিয়েছিলেন একাত্তরে।
দেখা শেষে জাদুঘরের পরিদর্শন বইতে মনের কথাগুলো জানিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা লিখেছেন: ২৫ নভেম্বর ১৯৭১,সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ঘরের ভেতর আমাদের কয়েকটি খাটের পোড়া তক্তা, মুক্তিযুদ্ধকালে আমার ও সহযোদ্ধাদের একটি ছবি জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। স্মৃতি ধরে রাখায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।’
জাদুঘরে ভারতের ট্রেনিং ক্যাম্প, মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া সহযোদ্ধাদের ছবি মনে ওঠার কথা জানিয়েছেন মো. নূরুল আমিন নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি লিখেছেন: আমি একজন ভারতীয় ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। আমি ও আমার বড় ভাই জীবন বাজি রেখে ভারতের অম্পি নগরে ট্রেনিং নিতে যাই। ট্রেনিং নিতে যাওয়ার যাত্রাটা এমন বিভীষিকাময় যে বলা-বর্ণনা করতে গেলে হৃদয় বিদীর্ণ হয়। মনে পড়ে ক্যাপ্টেন জে.কে শর্মার কথা। সাথীরা অনেকেই বেঁচে নেই, কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসে সবার ছবি মনে ভেসে আসলো।
একাত্তরে সরাসরি সম্মুখযুদ্ধ না করলেও সেই সময়ের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো অনেকের অন্তরে মুক্তিযুদ্ধ আলোড়ন তোলে।
মুক্তিযুদ্ধে নিজের চোখে শহীদ হতে দেখার স্মৃতি কথা তুলে ধরে বরিশালের সৈয়দ ছরওয়ার হোসেন লিখেছেন: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমার বয়স ১২ বছর ছিল, শারীরিক সক্ষমতা ছিলো না তবে সবকিছু দেখেছি। বরিশাল অঞ্চলে প্রবেশের সময় প্রথম যুদ্ধে আমি অস্ত্রহীন ভাবে প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেখানে চারজন পাকিস্তানি সেনা ও ২ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং ১২ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। এদের মধ্যে বাবু মঙ্গল নন্দী এবং তার ভাতিজাও নিহত হন। উনি চরকী বন্দর হাইস্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন।
সৈয়দ ছরওয়ারের মতোই একাত্তরে সরাসরি যুদ্ধ না করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা তোফাজ্জল হোসেন মজুমদার লিখেছেন: আমি মুক্তিযোদ্ধা নই,দেখেছি যুদ্ধ। মৃত্যুকে দেখেছি খুবই কাছ থেকে। বাবার সঙ্গে ৯ মাস কেটেছে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য সংগ্রহে। আমাদের বাড়িতে ছিলো সাবক্যাম্প। অনেক কথাই হারিয়ে ফেলেছি। অনেক বেদনাবিধুর ছিলো সেইসব দিন। নিজের চোখে দেখা ইতিহাস অনেক গভীরে গেঁথে রেখেছি। অনেক সময় বলতে চাই,সময় কুলায় না। ৪৫ বছর চলে গেছে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছি, আমি ধন্য যে আমি বাঙালি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের আতঙ্কের কথা জানিয়ে জিন্নাত আরা খানম লিখেছেন: আজ এখানে এসে ফিরে গেলাম ৭১ এ। তখন ছিলাম ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। মুক্তিযুদ্ধের চাক্ষুস সাক্ষী আমি। মাধবপুর থানার সেই দিনগুলো কি যে আতঙ্কময় ছিল তা আজ মনে পড়ছে।
এরকম টুকরো টুকরো স্মৃতিতে ভরা খণ্ড খণ্ড ইতিহাস লেখা আছে ৭’শ পৃষ্ঠার পরিদর্শন বইগুলোতে।
জাদুঘরের শিক্ষা ও প্রকাশনা ব্যবস্থাপক সত্যজিৎ রায় মজুমদার চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান, এবছর এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেগুনবাগিচা থেকে আগারগাঁওয়ে নিজস্ব ভবনে বড় পরিসরে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত মন্তব্যের জন্য খোলা দু’টি পরিদর্শন বই একাত্তর দেখা মানুষদের স্মৃতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের পরিচয় খুঁজে পাওয়া মন্তব্যে পরিপূর্ণ হয়েছে। এ মাসেই তৃতীয় পরিদর্শন বইটি খোলা হয়েছে। এই বইটিও মন্তব্যে পূর্ণ হবে বিজয়ের এই মাসে।