অক্টোবরের শেষ থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি #মি টু- বিডি নিয়ে সরগরম ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম। #মি টু নিয়ে আলোচনা কেবল নারীদের প্রতিবাদের জায়গা হয়ে উঠছে এমনটাই নয়, নিপীড়ক পুরুষকে সাবধান করে দিচ্ছে বহু বছরের নিপীড়নের মনস্তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে, এটাই বা কম কি? যেদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিরাজ করে সেখানে অপরাধ হবে এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নকে বড় কোন অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। আর সে কারণে বহু বছর ধরে পার পেতে পেতে নিপীড়কদের মনে কোন ভয় কাজ করে না। যখনই একজন দুজন করে বেশ ক’জন বলতে শুরু করেছেন, তখনই শুরু হয় ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’।
যেমন করে ধর্ষিত হওয়ার অপরাধে ধর্ষিতাকে দায়ী করা হয় কাপড় চোপড় ঠিক ছিলো না কিংবা এত রাতে বাইরে কি করছিলো এসব বলে।
কারো সম্মতি ছাড়া যৌনতা এক ধরণের নিপীড়ন সেটা আমার সমাজ বুঝতে রাজি নয়। আর আজ যখন নারীরা বহুদিনের আড়ষ্টতা ভেঙে সাহস করে কথা বলছে সেটা হয়ে যাচ্ছে ‘ফাঁদ’। সে কারণেই ভার্চুয়ালকে পাশে রেখে তৈরি করা উচিত সামাজিক প্রতিরোধ।
আমি নিজে আমার নিপীড়নের গল্প ১৫ বছর পর পরিবারের সাথে শেয়ার করেছি এবং সেই ব্যক্তি কোন ভাবেই যেন আমার ছোট কাজিনদের কাছে আসতে না পারে সে ব্যাপারে মা-খালাদের সতর্ক করেছি। আমার কথা শুনে তারা একটু অবাক হলেন যে কেন এতদিন বলিনি। এই যে আড়ষ্টতা, ভয় আমার মধ্যেও কাজ করেছিলো।
#মি টু আমাকে সাহস জুগিয়েছে। ফেসবুকে লিখলে সবাই জানতো শেয়ার করতো সেটাতে সমস্যা ছিলো না। কিন্তু সেই অপরাধীকে ফেসবুকে এক্সপোজ না করে বরং পরিবারের কাছে বলাকেই আমার ভালো মনে হয়েছে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা যেন পরিবারের অন্য কারো না হয় সেটাই আমার চাওয়া।
একটু একটু করে সামাজিক প্রতিরোধ তৈরি হচ্ছে, একটি প্রভাবশালী পত্রিকা ক্ষমা চেয়েছে। যেসব ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে এসেছে সেটার তদন্ত চলছে। মানববন্ধন, লেখালেখি, গোলটেবিল চলছে। তবে আমি বলবো অন্য দেশের তুলনায় আমাদের অগ্রগতি কম। হয়তো এ ঘটনাগুলো যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কঠোর কোন আইনের সূত্রপাত করবে।
সেজন্যও দরকার আরো বেশি করে জানানো, ভার্চুয়াল মাধ্যমে কিংবা বাস্তবে। ভিক্টিম ব্লেমিং হবেই, অনেক মানুষ ভিক্টিমকে হুমকি দেবে, একজন-দুইজন-তিনজনকে দেবে কিন্তু শত নারীকে তো আর কোন ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। বিচার চাইতেই হবে, আমার সাথে অন্যায় হলে সেটার বিচার অবস্থার প্রেক্ষিতে না পেলে এখন সেটা সুনিশ্চিত করতে হবে। নাহলে নিপীড়নমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব।
আমাদের দেশে এমন কোন মেয়ে খুঁজে পাওয়া দুস্কর যে জীবনে কখনও নিপীড়নের শিকার হয় নি। কিন্তু নিপীড়ন প্রকাশের জায়গা ছিলো খুব সীমিত। ফেসবুক এসেছে বছর দশেকের বেশি হলো, এখনও কি চাইলেই সবাই সব কিছু বলতে পারছে। উত্তর হলো না। নানা ধরণের বাধা থাকে পরিবার, কর্মস্থল, বন্ধু, আত্মীয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এসব নানা সমীকরণ মিলিয়ে নারী কিন্তু নিজের মনস্তত্ত্ব জানান দেয়ার সুযোগ পায় না।
সে কারণেই #মি টু কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে থেকেই একটা দারুণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। এই প্রেক্ষাপট থেকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই #মিটু নিয়ে ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে বোঝা উচিত।
দুই-একজন ছেলেও তাদের সাথে ঘটে যাওয়া নিপীড়নকে শেয়ার করেছে ফেসবুকে। এ শুধু নারীর জন্য আন্দোলন, সব পুরুষের বিরুদ্ধে আন্দোলন-এমন নয়। বরং নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলার জায়গা নারীকে দেখছে অধ:স্তন কিংবা দাস হিসেবে।
কেবল এই মনে বত্তিকে দূর করা গেলেই নিপীড়ন প্রতিরোধ সম্ভব। এজন্য চাই আলোর মুখ দেখানো এই প্ল্যাটফর্মকে সামাজিক মাধ্যমের বাইরেও আলোচনা করা।
কিছুদিন আগে বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হওয়া লিট ফেস্টে বেশ কিছু সেশন দেখার সুযোগ হয়েছে। মনীষা কৈরালা আর নন্দিতা দাশের একটা সেশন ছিলো ‘ব্রেকিং ব্যাড’ নামে। নারী হিসেবে পরিচালনা করা, অভিনয় করার পেছনে তাদের যে সংগ্রাম, নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করা সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করতে এরকম বিষয় নিয়ে আলোচনা ছিলো, সেখানেও ঘুরে ফিরে # মি টু আসে।
মনীষা প্রশ্নের উত্তর দায়সারাভাবে দিলেও নন্দিতা বেশ ভালোভাবেই কথা বলেছেন। দুজনেই বলেছেন #মি টু হতে গিয়ে তা যেন ‘সোশ্যাল মিডিয়া মব’ না হয়ে যায়।
অর্থাৎ যিনি নিপীড়ত তাকে যেন সোশ্যাল মিডিয়াতে বিচার করা না হয়, এবং যিনি নিপীড়ক তিনিও যেন মবের শিকার না হন। বরং এ ধরণের অপরাধের বিচার যেন হয় সেটা দুজনেই আলোচনা করেছেন।
আরেকটি সেশন ছিলো, সাহিত্যে নোবেল ও #মিটু মুভমেন্ট নিয়ে। ‘নো নোবেল: #মিটু ইন লিটারেচার’ এই শিরোনামের সেশনে অংশ নিয়েছিলেন জার্মান লেখক ওলগা গ্রাসনোয়া, ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও অধ্যাপক ফিলিপ হেনশার, ব্রিটিশ লেখক রিচার্ড বিয়ার্ড, আমেরিকান লেখক রস পটার ও ভারতীয় লেখক, সম্পাদক ও সমাজকর্মী হিমাঞ্জলি শংকর।
বক্তারা জানান এই আন্দোলনের কারণে সাহিত্যে নোবেল দেয়া বন্ধ হয়েছে এবং তারা একে সমর্থন করেন। তারাও সামাজিক প্রতিরোধের ওপরই জোর দিয়েছেন।
এমনকি তারা সাহিত্য ও শিল্প মহলে ক্ষমতার চর্চায় এক বিরাট পরিবর্তন বলেও মনে করছেন।
এই সেশনগুলো থেকে নেয়া শিক্ষা আমাদের শিল্পী-সাহিত্যিক কিংবা শিল্প-সাহিত্য রসিকদের মনে আদৌ কি প্রভাব ফেলতে পেরেছে? শুধু তারাই নন, সমাজের প্রতিটি শিক্ষিত কিংবা সচেতন মানুষের মধ্যে কি সামাজিক গণমাধ্যমে গড়ে ওঠা আন্দোলন প্রভাব ফেলতে পারছে? তারা কি আদৌ এ ধরণের অভিযোগ হজম করতে পারছেন?
প্রশ্ন থেকেই যায়, যখন দেখি কোন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিকে মহাপুরুষ জ্ঞান করে নিপীড়িতকেই কৌশলে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। মহাপুরুষ বা দেবতা কিংবা স্বীয় অঙ্গনে মহাকাব্যিক ভূমিকা রাখা মানুষকে আপনি চিনতে পারছেন তার কাজ নিয়ে, ব্যক্তি মানুষকে কি সেই হিসেবে জানার সুযোগ আপনার হয়েছে? আর যদি হয়েও থাকে তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা পশুগুলো কি আপনাকে দেখা দিয়েছে? যদি না হয়, তাহলে নীরবতা পালনই শ্রেয় বলে আমি মনে করি।
জাজমেন্টাল না হয়ে বরং নিপীড়নের বিরোধী হয়ে উঠুন। ব্যক্তির প্রতি ভালোবাসা আপনার থাকতেই পারে, সেজন্য এই আন্দোলনকে আপনি বৃথা বলতে পারেন না।
আমি আশাবাদী, বহু বছরের রুদ্ধ মনের দুয়ার খুলে মেয়েরা যেমন নিজেকে নিয়ে বলছে, ছেলেরা যেমন তাদের না বলা কষ্টকে জানাচ্ছে। সচেতনতা তৈরি হবেই।
ভার্চুয়াল থেকে #মি টু চলবে সমাজের সব পরিসরে। আমরা নিরাপদ পরিবেশ পাই নি, কিন্তু ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন পায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)