বিপিএলের পঞ্চম আসরের পর্দা নামবে আর কয়েকঘণ্টা পরই। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টুয়েন্টি টুর্নামেন্ট লিগটির এবারের মাঠের লড়াইয়ে রোমাঞ্চ ছড়িয়ে ফাইনালে উঠেছে সাকিবের ঢাকা ডায়নামাইটস ও মাশরাফীর রংপুর রাইডার্স। আসর শুরুর আগে থেকেই কাগজে-কলমে টুর্নামেন্টের শক্তিশালী দলের তকমা পেয়েছে দলদুটি। শক্তিশালী ঢাকা পরে দাপটের সঙ্গেই শিরোপামঞ্চে এসেছে, আর মাঝপথে ধুঁকে প্লে-অফে স্বরূপে ফিরে টগবগিয়ে জ্বলছে রংপুর। সবকিছু ছাপিয়ে তাই আলোচনায় রংপুর। প্রথম তিন আসরের চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক যে আছে দলটির ভাণ্ডারে, তিনি মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা নামের এক ‘পরশপাথর’।
মাশরাফীকে যে ফ্র্যাঞ্চাইজিই দলে টেনেছে, তাদেরই শিরোপার স্বাদ পাইয়ে দিয়েছেন! ব্যতিক্রম শুধু গত আসর। চতুর্থ আসরে শিরোপা ঘরে তোলে সাকিবের ঢাকা ডায়নামাইটস। সেই সাকিবের কাছ থেকেই শিরোপা কেড়ে ভাণ্ডার আবারও সমৃদ্ধ করার পালা টাইগারদের ওয়ানডে অধিনায়কের। যাতে আবারও হয়ত চওড়া হবে স্লোগানটা- মাশরাফীকে নাও, চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাও!
দেশের ক্রিকেটে মাশরাফীর নামে স্লোগান ওঠা হরহামেশার ব্যাপার। সেটা তার খেলোয়াড়ি আর নেতৃত্ব, দুটিগুণের কারণেই। বিপিএলও সেটার ঝলক দেখেছে। প্রথম দুই আসরে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সকে শিরোপা এনে দিয়েছিলেন ম্যাশ। পরে বিরতি দিয়ে আবারও যখন মাঠে গড়াল বিপিএল, ২০১৫ সালে নড়বড়ে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সকেও শিরোপার হাসি উপহার দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন টাইগারদের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। কুমিল্লার জার্সিতেই চতুর্থ আসরটা বিরতি গেছে। সম্ভাবনা জেগেছে আবার পরের আসরেই।
বিপিএলের প্রথম আসরে ২০১২ সালে ক্রিস গেইলের দানবীয় ব্যাটিংয়ে প্রতিপক্ষ দলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল বরিশাল বার্নার্স। সেবার গ্রুপ পর্বের প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতেই সেঞ্চুরি করেছিলেন গেইল। তবে সেমিফাইনালের আগে তিনি দেশে ফেরায় শক্তি হারিয়েছিল দলটি। এরপরও পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ খেলতে থাকা বরিশালকে ফাইনালে হতাশ করেছিল আরেক শক্তিশালী দল মাশরাফীর গ্ল্যাডিয়েটর্স।
গেইল চলে গেলেও বরিশালের হয়ে আহমেদ শেহজাদ দুরন্ত রাজশাহীর বিপক্ষে ৪৯ বলে ১১৩ রানের হার না মানা এক দানবীয় ইনিংস খেলে দলকে ফাইনালে নিয়েছিলেন। কিন্তু শিরোপার স্বপ্ন বুনতে থাকা দলটি ফাইনালে এসেই নিষ্প্রভ হয়ে আত্মসমর্পণ করে মাশরাফীদের বিপক্ষে।
ফাইনালে ব্র্যাড হজের অপরাজিত ৭০ রানে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের বিপক্ষে নির্ধারিত ওভারে ৭ উইকেটে মাত্র ১৪০ রান তুলতে সক্ষম হয়েছিল বরিশাল। ঢাকা যে লক্ষ্য টপকে যায় মাত্র ২ উইকেট হারিয়েই, সেটিও ১৫.৪ ওভারে। মাশরাফী সেদিন ব্যাটিংয়ে নামার সুযোগ পাননি। বল হাতে ২ ওভারে ১৭ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য। সেটি দলের লড়াকু মনোভাব জারি রাখতে কোন ব্যাঘাত ঘটায়নি। কারণ তিনি যে মাশরাফী নামের এক ‘পরশপাথর’।
বিপিএলের পরের আসরে ২০১৩ সালেও ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের দলনেতা ছিলেন মাশরাফী। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে প্রতিপক্ষ ছিল চিটাগং কিংস। শুরুতে ব্যাট করে এনামুল হক বিজয়ের ফিফটিতে নির্ধারিত ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ১৭২ রানের চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য গড়েছিল ঢাকা। জবাবে ১৬.৫ ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ১২৯ রানেই গুটিয়ে যায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের চিটাগং।
৪৩ রানে জয়ের সেই ম্যাচে ৩ বলে দুই চারে ৮ রান করার পাশাপাশি ৩ ওভারে ২৫ রান খরচায় ১ উইকেট নিয়েছিলেন মাশরাফী। সঙ্গে উঁচিয়ে ধরেছিলেন চ্যাম্পিয়ন খেতাবের শিরোপাটি।
এক মৌসুম বিরতি দিয়ে ২০১৫ সালে তৃতীয় আসর মাঠে গড়ায় বিপিএলের। এবারও মাশরাফীর ফাইনাল প্রতিপক্ষ দলনেতা ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তবে দুজনের দলেই এসেছিল পরিবর্তন। মাহমুদউল্লাহ নাম লিখিয়েছিলেন বরিশাল বুলসে আর মাশরাফীকে দলে ভিড়িয়েছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স। শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটিও হয়েছিল জমজমাট। কিন্তু শেষ হাসি সেই মাশরাফীর।
তৃতীয় আসর শুরুর আগে মাশরাফীকে ঘিরে করা ভিক্টোরিয়ান্স ফ্র্যাঞ্চাইজির একটি মন্তব্য বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। ফ্র্যাঞ্চাইজিটি নাকি অনিচ্ছাসত্ত্বেও মাশরাফীকে দলে নিতে বাধ্য হয়েছিল! কারণ অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিরা বাকি আইকনদের দলে ভিড়িয়েছে, তাতে না নেয়ার তালিকায় ছিলেন কেবল মাশরাফী! তাই একরকম বাধ্য হয়েই দলে নেয়া! কিন্তু সেই বিতর্কতে ছাপিয়ে পুরো টুর্নামেন্টেই দাপুটে ক্রিকেট উপহার দিয়েছিল মাশরাফীর দল। টুর্নামেন্টজুড়ে বেশকিছু শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ খেলা বরিশালও ছিল দুর্দান্ত।
ফাইনালেও মাশরাফীর ভিক্টোরিয়ান্সের সঙ্গে সমানতালে লড়াই করেছিল বুলসরা। একটা সময় দলটির শিরোপা জয় সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছিল। তবে অলক কাপালীর বীরত্বগাথা শেষ পর্যন্ত বরিশালের দুঃখগাথায় রূপ নেয়। শেষ ৫ বলে জয়ের জন্য কুমিল্লার দরকার ছিল ১২ রান। দুর্দান্ত দৃঢ়তায় পর পর দুটি চার মারায় ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় কুমিল্লার হাতে। ইনিংসের শেষ বলে এক রান নিয়ে প্রথমবারের মতো বিপিএলে অংশ নেয়া কুমিল্লাকে শিরোপা এনে দেন কাপালী। আর পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই ব্যাটে-বলের পাশাপাশি কাপালীর মত ক্রিকেটারদের মনস্তত্ত্বে উদ্দীপ্ত করে আলোটা নিজের দিকে কেড়ে রেখেছিলেন ‘পরশপাথর’ মাশরাফী।
ম্যাচে টস জিতে বরিশালকে ব্যাটিংয়ে পাঠান মাশরাফী। তাতে নির্ধারিত ওভারে ৪ উইকেট হারিয়ে ১৫৬ রানের মাঝারি সংগ্রহ গড়েছিল বুলসরা। জবাবে শ্বাসরুদ্ধকর সমাপ্তির ম্যাচে ৭ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে যায় ভিক্টোরিয়ান্সরা। মাশরাফী সেদিন ব্যাট হাতে রানের খাতা খুলতে পারেনি। বল হাতে ৪ ওভারে ২৮ রান খরচায় নিয়েছিলেন ১টি উইকেট। কিন্তু পুরো টুর্নামেন্ট জুড়েই দুর্দান্ত ছিলেন। এমনকি ব্যাট-বল করার জন্য নয়, কেবল অধিনায়কত্ব করার জন্যই তাকে দলের নেয়ার পরিস্থিতিও সৃষ্টি করেছিলেন! বিনিময়ে দলকে শিরোপা উপহার দিয়েই আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন।
কয়েকঘণ্টা পরেই পর্দা উঠছে আরেকটি বিপিএলের। সুসংগঠিত ও শক্তিশালী দল গড়েছে রংপুর। গেইল, চার্লস, ম্যাককালাম, বোপারার মত বিদেশি, সোহাগ গাজী, রুবেল, জিয়াউর, অপুদের মত দেশিরা আছেন, সঙ্গে আছেনই এক ‘মাশরাফী’। আলোচনা তাই তুঙ্গে- আবারও হয়ত হাসতে যাচ্ছে মাশরাফীর দলই। আবারো হয়ত শিরোপা উঁচিয়ে ধরবেন তিনি!
এক মাসের ক্রিকেট মহাযজ্ঞের দিকে নজর রাখলে অবশ্য খানিকটা হিসেবিই হতে হচ্ছে। রংপুর জয়ে শুরু করার পর একেবারেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফেলেছিল। একসময় সেরা চার সুদূরপরাহতই মনে হচ্ছিল। সেমিফাইনাল জিতে মাশরাফী অকপটেই স্বীকার করেছেন যেটি। কিন্তু সেরা চারে এসেই জ্বলে উঠতে থাকলেন রংপুরের সেরা নামগুলো।
গেইলের শতক, যেটি এবারের বিপিএলের প্রথম শতক, এলিমিনেটরের বাধা টপকে নেয় রাইডার্সদের। বৃষ্টি বিঘ্নিত নাটকের কোয়ালিফায়ারে জোনাথন চার্লসের শতক, ম্যাককালাম ঝড় তুলে নেয় ফাইনালেন। টুর্নামেন্টজুড়েই বোপারা-মাশরাফী সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে গেছেন। গ্রুপপর্ব ছিল তাই দলীয় প্রচেষ্টার ফসল। শেষের মঞ্চে আরেকবার সম্মিলিত সেই প্রচেষ্টার দেখা মিললে উড়ে যেতে পারে যেকোনো দলই।
অবশ্য সাকিবের ঢাকাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। সাকিবের সঙ্গে আফ্রিদি, আমির, আবু হায়দার, এভিন লুইস, সুনীল নারিন, মোসাদ্দেক সমৃদ্ধ দল শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীতা গড়ার জন্য যথেষ্ট। পুরো টুর্নামেন্টেই তারা সেটি দেখিয়ে এসেছে। সবার আগে ফাইনালের টিকিট পেয়েছে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ডায়নামাইটসরাই। মাঠে ব্যাটে-বলের লড়াইয়ে সন্ধ্যা ৬টার ম্যাচকে ঘিরে তাই রোমাঞ্চ জমাট বাঁধার অপেক্ষা করতেই পারেন ক্রীড়াপ্রেমীরা।
তারপরও পাল্লাটা ঝুঁকে যায় রংপুরের দিকেই। সেটা ওই ‘পরশপাথর’ মাশরাফী আছেন বলেই। সেমিফাইনাল হারের পর পরাজিত অধিনায়ক তামিম ইকবালই যেমন মনে করিয়ে দিলেন কারণটা, ‘রংপুর অনেক লড়াই করে এখানে এসেছে। যারা এভাবে এক রান, দুই রান বা এক উইকেট, দুই উইকেট নিয়ে উঠে আসে; আমি সব সময় সেই দলগুলোকে ভয় পাই। আমার মনে হয় যে এই টিমগুলোর সঙ্গে ভাগ্যটা সব সময় কাজে দেয়। এমনকি তাদের সুপারস্টাররা যেসব ম্যাচে পারফর্ম করল না, সেসব ম্যাচও তারা কোনভাবে জিতে নিয়েছে। …এবং মাশরাফী ভাই যেভাবে লিড দিয়েছে, সুপারস্টার পারফর্ম না করলেও জিতিয়েছে।’
তামিমের বলা কথার শেষ লাইনটার অর্থই ‘মাশরাফীকে নাও, চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাও!’ নয়কি?