ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক জালিয়াতির মাধ্যমে সম্পদ দখল করে রাষ্ট্রের হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সিলেটের শিল্পপতি রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইকে ১৪ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আদালত। রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, এই রায় মানবিক মুখোশ পরে অবৈধ প্রক্রিয়ায় জনসম্পদ আত্মসাতের বিচারে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাই অর্থবিত্তে বলীয়ান দেশের অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই ধরনের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বর্তমান বাংলাদেশে তাদের অবৈধ প্রভাবকে ব্যবহার করে কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে খাঁটি হিসাবে ব্যবহার করে, তারও এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ ১৯৯৯ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জালিয়াতির অভিযোগে ২০০৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন তখনকার ভূমি কমিশনার (এসি ল্যান্ড) এসএম আব্দুল কাদের। মামলায় রাগীব আলী ও তার ছেলের বিরুদ্ধে সিলেটের তারাপুর চা বাগানের ৪২২ একর জমি আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জাল করার অভিযোগ আনা হয়। দেবোত্তর এই সম্পদের মূল্য হাজার কোটি টাকা। মামলার বিরুদ্ধে রাগীব আলী উচ্চ আদালতে যান। আপিল বিভাগ গত বছরের ১৯ জানুয়ারি রাগীব আলীর বিরুদ্ধে মামলা পুনরায় চালুর নির্দেশ দেন। সেসঙ্গে তারাপুর চা-বাগান দখল করে গড়ে ওঠা সব স্থাপনা ছয় মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। আপিল বিভাগের আদেশের পর গত বছরের ১০ জুলাই সিলেটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই এর অতিরিক্ত সুপার সারোয়ার জাহান আদালতে অভিযোগপত্র দেন। অভিযোগে বলা হয় রাগীব আলী ও তার ছেলে আব্দুল হাই ১৯৯০ সালে ভূমি মন্ত্রণালয়ের স্মারক (চিঠি) জাল করেন। অভিযোগপত্র গ্রহণ করে গত বছরের ১০ আগস্ট রাগীব আলী ও তার ছেলে আবদুল হাইসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন সিলেট মহানগর মুখ্য হাকিম আদালত। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির খবরে ওই দিনই জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে সপরিবার ভারতে পালিয়ে যান রাগীব আলী। গত ১২ নভেম্বর ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে রাগীব আলীর ছেলে আব্দুল হাইকে গ্রেপ্তার করে জকিগঞ্জ ইমিগ্রেশন পুলিশ। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ভারতে অবস্থানের অভিযোগে গত ২৪ নভেম্বর সেদেশে গ্রেপ্তার হন রাগীব আলী। ওইদিনই সিলেটের সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনে কারাগারে পাঠানো হয়। আপিল বিভাগের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন গত ১৫ মে চা-বাগানের সেবায়েত পঙ্কজ কুমার গুপ্তর কাছে ৩২৩ একর জমি বুঝিয়ে দেয়। আমাদের দেশে দখলদারিত্বের এরকম অনৈতিক চর্চা মোটেই নতুন নয়। ভূমিদস্যুদের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। বড়বড় ভূমিদস্যুদের নিয়ে সমাজের প্রচুর আলোচনা, সমালোচনা, নিন্দা আমাদের চোখে পড়ে। দেশের গণমাধ্যমগুলোতে ভুরি ভুরি সংবাদ হয়েছে। সে তুলনায় আমরা কী বিচারের দৃষ্টান্ত দেখতে পাই? বিচার হয় না বলেই আরো আরো নীতিহীন মানুষ সেই অনৈতিক পথে পা বাড়ায়। তারা আরো লোভী হয়ে উঠে। তারা যে শিক্ষা-দীক্ষাহীন মানুষ তা কিন্তু নয়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত-প্রভাবশালী মানুষগুলোর কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ গ্রাস করে আরো সম্পদশালী, আরো ক্ষমতাধর হতে চায়। রাগীব আলী আর তার ছেলের অপরাধের বিচারের মধ্য দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। আবারো প্রমাণিত হলো কেউই বিচারের ঊর্ধে নয়। আর যতো সূক্ষ জালিয়াতিই হোক তা একদিন না একদিন দৃষ্টিগোচর হবেই। কারণ ধর্মের কল বাতাসে নড়ে!