চারদিকে হিংসা, মারামারি, কাটাকাটি, নোংরামিতে অভ্যস্ত আমরা বিশ্বকাপ ফুটবলেও কমবেশি শক্তিপ্রয়োগের মহড়া দেখছি। কলাম্বিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচটির কথাই ধরা যাক। কুৎসিত ফুটবলের মহড়া দিয়েছে দু’দল।
কলম্বিয়া ফাউল করেছে ২৬টি আর ইংল্যান্ড ১৩। ফলে বারবার হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েছেন খেলোয়াড়েরাও। রেফারিকেও দেখাতে হয়েছে হলুদ কার্ড। কলম্বিয়া হলুদ কার্ড দেখেছে ছয়টি আর দুটি ইংল্যান্ড।
এই খেলাটি দেখতে দেখতে বার বার মনের পর্দায় ভেসে উঠছিল ঢাকার রাজপথে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের পক্ষের আন্দোলনকারীদের পেটানোর দৃশ্যগুলো। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত লাঠি দিয়ে পেটানো, কিল-চড়-লাথি, হাতুড়ি দিয়ে পা থেতলে দেওয়ার দৃশ্যগুলোর সঙ্গে বিশ্বকাপের ম্যাচটির মধ্যে কোথায় যেন মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম। বিশ্বকাপ ফুটবল মহোৎসবের প্রতি সংহতি জানাতেই কিনা, জানি না, গত কয়েকদিন ধরে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থকদের নির্মমভাবে ‘পেটানোর উৎসব’ পালন করছে। আমরা উভয় ক্ষেত্রেই দর্শক সেজে বসে আছি। যেন হাততালি দেয়া কিংবা না-দেয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার নেই!
যা হোক, আমার বিবেচনায় এবার বিশ্বকাপে নানা অন্ধকারের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলোর ঝলকানির নাম-জাপান। বিশ্বকাপে সবচেয়ে মস্ত বিস্ময়টি উপহার দিয়েছে জাপান। মানবতার কণ্ঠরোধ থেকে শুরু করে জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদের অমানবিকতায় দূষিত বর্তমান বিশ্বেও এক নতুন ‘আদর্শ’কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে জাপানি ফুটবল দল। ফুটবল-বিশ্বে এশিয়াকে এক ঝটকায় বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে দেওয়ার জন্য তো নিশ্চয়ই। সেই ক্রীড়া-মুনশিয়ানার চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করছেন এবং করতেই থাকবেন দক্ষ ফুটবল-বিশারদেরা। আমজনতার প্রশংসা কিন্তু প্রস্তুত থাকছে জাপানের জন্য। সৎ-সরণি ধরে, ‘এইচ’ গ্রুপের শেষ খেলায় পোলান্ডের কাছে হেরেও তার শেষ ষোলোয় পৌঁছে যাওয়ার জন্য।
এইচ গ্রুপে জাপানের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেগালও প্রথম পর্বের খেলায় দিয়েছে চার গোল, খেয়েছেও চার গোল। জাপানও ঠিক তা-ই। পয়েন্ট দু’দলেরই সমান। গোল-সমতা বা গোল-পার্থক্য, যা-ই বলা হোক, তাতেও দুই দল এক অবস্থানে। কারা তবে যাবে প্রতিযোগিতার পরবর্তী ধাপে? যাওয়া উচিত কাদের?
এখানেই নির্ণায়ক ভূমিকা নিল অমলতা। দু’বাহু বাড়িয়ে অভয় নিয়ে এল সে জাপানের কাছে। জয় হলো জাপানের ‘অমল’ ফুটবলের। অমল মানে হচ্ছে মল বা ময়লা নেই এমন, নির্মল, অনাবিল, পরিষ্কার, কালিমামুক্ত। সুন্দর, সাদা, পরিচ্ছন্ন, খাঁটি। এর আগে জাপানকে যেন কোচ প্রতিজ্ঞা করে মাঠে নামিয়েছিল: গোল করতে পারো না-পারো, গ্রুপের শেষ ম্যাচে পোলান্ডের কাছে একাধিক গোল খাওয়া চলবে না। সর্বোপরি চলবে না কার্ড দর্শন— হলুদ কার্ড দর্শন নয়, লাল কার্ড দর্শন তো নয়ই। অর্থাৎ রক্ষণের চৈনিক প্রাচীর হয়ে ওঠো একাদশ সেনা। আর? আর প্রতিপক্ষকে আঘাত নয় কোনও ভাবেই। কেননা একটি আঘাতই আমন্ত্রণ করে আনতে পারে একটি হলুদ বা একটি লাল কার্ড। তা হলেই সমূহ পতন। কারণ, শেষ ষোলোর পথে নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী সেনেগালের তুলনায় এই একটি জায়গাতেই এগিয়ে আছে জাপান। সেনেগাল হলুদ কার্ড দেখেছে ছ’টি। জাপান চারটি। তুলনামূলক অমলতায় এই সামান্য এগিয়ে থাকাটুকুই আখেরে অসামান্য হয়ে উঠতে পারে, মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন জাপানের কোচ। হলও তা-ই। বিশ্বকাপে জাপানের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠল সেই ফেয়ার প্লে, অমল, অমলতা।
জাপানি কোচের এই রণকৌশলে হয়তো ছিল নির্ভেজাল গণিত। পাখির চোখ হয়তো ছিল শুধু প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা, শেষ ষোলোর এক্সপ্রেসে পা রাখার জায়গা করে নেওয়া। কোচের এই রক্ষণাত্মক রণনীতির জন্য সে দিন জাপানি ফুটবলারদের প্রভূত বিদ্রুপ-টিটকিরি সইতে হয়েছে মাঠে। আগ্রাসী লড়াইয়ের উত্তেজক মদিরার অভাবে অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে দেখা গিয়েছে মহার্ঘ টিকিট কেটে মাঠে ঢোকা দর্শকের একাংশকে।
কিন্তু জাপানি কোচ যা করলেন, যা করালেন তার এগারো জন সৈনিককে দিয়ে, তা বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিবৃত্তে স্বতন্ত্র অধ্যায়ের দাবিদার তো বটেই। বিশ্বজোড়া হননক্রীড়ার ময়দানেও সেটা মানবতার এক অভিনব পাঠ। আত্মরক্ষা, কিন্তু আঘাত নয়। খেলা, কিন্তু অনৈতিকতা নয়। অমলতাই শেষ আশ্রয়। অন্তিম অবলম্বন। এই মন্ত্রেও যে এগোনো যায়, এই মন্ত্রেই যে এগোনো উচিত, সেই শিক্ষা, সেই মহাশিক্ষকতা সম্পন্ন করলেন জ়েন-কাব্যের দেশ, উদিত সূর্যের দেশের ফুটবল আচার্য আকিরা নিশিনো।
পরের ম্যাচে বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের মতো দুর্দান্ত দলের বিরুদ্ধে ২-০ এগিয়ে গিয়েও শেষমেশ ৩-২ হার! এডেন অ্যাজারদের বিরুদ্ধে তাকাশি ইনুইদের হারের পরেও দেখলাম বিশ্বজুড়ে প্রশংসা হচ্ছে জাপানিদের ফুটবল মাঠে মরণপণ সংগ্রামের। ম্যাচ শেষে টুইটারে জাপানের প্রশংসা করছেন প্যাট্রিক ক্লুইভার্ট, সল ক্যাম্পবেলরাও।
জাপানের সাফল্যকে অবিশ্বাস্য মনে হয়। ইউরোপীয়দের মতো উচ্চতা ও শক্তি নেই, লাতিন আমেরিকার সূক্ষ্ম শিল্পকলা নেই, কিন্তু সবই যেন কিছু কিছু আছে। সব কিছু মিলিয়েই বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রায় প্রথম স্তরে জাপান। বেলজিয়াম এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের একটা সাড়া জাগানো শক্তি। এই বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দল কোচ রবের্তো মার্তিনেজ-এর হাতে। তাদের বিরুদ্ধে যে লড়াইটা এ দিন করলেন কেইসুকে হোন্ডারা তা দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠছে। জাপান ম্যাচটা না জিতলেও রাশিয়ায় বিশ্বকাপ শেষ করল হৃদয়ে থেকে। ম্যাচটা ২-২ হওয়ার পরে জাপানের গোলকিপার এইজি কায়াশিমা যে রকম গোলের তলায় একা কুম্ভ হয়ে মারুয়ান ফেলাইনি, অ্যাজারদের আক্রমণগুলি রুখছিলেন তা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। গর্ব হচ্ছিল, বেলজিয়ামের মতো এ রকম একটি শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে এশিয়ার একটি দেশের পারফম্যান্স দেখে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য জাপান হেরে গেছে। এই হারে তাই কষ্টের বদলে গর্বই হয়েছে। চার বছর পর কাতারে অনুষ্ঠেয় ফুটবল আসরে জাপান নতুন সূর্যোদয় ঘটালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
সেই সঙ্গেই জাপানি কোচ প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেলেন: জীবনযুদ্ধের পাঠ্যক্রম থেকে ‘অল ইজ় ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ বা ‘দ্য রুলস অব ফেয়ার প্লে ডু নট অ্যাপ্লাই ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার’ আপ্তবাক্য বিসর্জন দেওয়ার সময় কি হল? বিশ্ব রাজনীতির পাঠ্যক্রম প্রণেতারা, ভূগোলক নিয়ে নিরন্তর রক্তাক্ত বন্দুকক্রীড়ায় মত্ত বিরাট শিশুরা একবার ভেবে দেখবেন কি?
পুনশ্চ: বিশ্বফুটবলে আমাদের দেশের অবস্থান প্রায় তলানিতে। কিন্তু সমর্থনের দিক থেকে আমরা প্রায় শীর্ষে। আমাদের ফুটবল সমর্থকরা নিয়ত নোংরামি, ঝগড়া, কলহ, বিদ্বেষ ছড়িয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ফুটবল সমর্থকদের কদর্য কাঁদা ছোঁড়াছুড়িতে পুরোপুরি নিমজ্জিত।
ওদিকে জাপানের ফুটবল দলের মতো জাপানি ফুটবল সমর্থকরাও অনন্য অসাধারণ আচরণ প্রদর্শন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশ্বকাপের যে কোনো ম্যাচ শেষ হওয়ার পর গ্যালারির আসনসহ পুরো স্টেডিয়াম সাধারণত ভর্তি হয়ে পরে মানুষের ফেলে যাওয়া খাবার, গ্লাস, কাপ, বোতল, ব্যানার, ফেস্টুন ও কাগজের জিনিসপত্রে। খেলা পরবর্তী এসব আবর্জনা খুব দ্রুত পরিষ্কারের জন্যে রয়েছে শত-শত পরিচ্ছন্নতা কর্মী। কিন্তু জাপানিরা এসবের ধার ধারে না। খেলা দেখতে আসার সময়ই তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসে পলিথিনের বিশাল ব্যাগ। খেলার ফলাফল যাই হোক, দল হারুক কিংবা জিতুক। স্টেডিয়ামের সকল ময়লা আবর্জনা তারা বস্তাবন্দী করে রাখে। তাদের বক্তব্য হল, স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে যে অবস্থায় এটাকে পেয়েছি, ঠিক সেই অবস্থায় এটিকে আমরা রেখে যেতে চাই! গত কয়েক বছর ধরেই খেলা দেখতে আসা জাপানি সমর্থকরা এই কাজটি করছেন।
অথচ আমরা যেন তার বিপরীত। আমরা ভিন্ন মতাবলম্বীকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পায়ের হাড় গুঁড়ো করে দিতে চাই। ভিন্ন দলের সমর্থকদের গালাগাল, অপমান করি, কদর্য আক্রমণে ফেসবুক ভরে ফেলি। সবাই যেন অলিখিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, আমাদের শহর ও পরিবেশ কে কার থেকে বেশি নোংরা করতে পারি, আরেকজনের সঙ্গে কে কার থেকে বেশি নোংরামি করতে পারি! আমাদের শহর ময়লা, রাজনীতি ময়লা, মনও ময়লা! আমরা বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে মাতোয়ারা হব, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে হৈহৈ আর হায় হায় করব; কিন্তু কিছুই কি শিখব না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)