বাংলাদেশ বিমান এয়ার লাইন্স নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে । এর অনিয়ম,দূর্নীতি ও চক্রান্ত নিয়ে ঘনঘন সংবাদ বেরোচ্ছে বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এব্যাপারে কিছু পত্রিকার শিরোনাম: ১৫নভেম্বর, ১৬ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের শিরোনাম: বিমানে নিয়োগ কেলেংকারী, মৌখিক পরীক্ষায় ফেল করলেও নিয়োগ নিশ্চিত, বেরিয়ে আসছে মহাদুর্নীতির অজানা কাহিনী। ১৮ ডিসেম্বর দৈনিক যুগান্তর শিরোনাম করেছে: বিমানে ভয়াবহ নিয়োগ দুর্নীতি, এই দিনই আরেকটি শিরোনাম হয়, বিমানের সাত কর্মকর্তা ফের রিমান্ডে, আরও একটি শিরোনাম হয়, বিমানের ত্রুটি: সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে।
দৈনিক যুগান্তর ৩১ডিসেম্বর, ১৬ শিরোনাম করেছে: ২০১৬ আলোচিত ঘটনা দশ। দশের মধ্যে প্রথমই থাকে বিমানের ঘটনা। বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, বিমানের ট্রাফিক হেল্পার পদে লোক নেয়া হবে ৬০ জন। এজন্য নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। কিন্তু লিখিত পরীক্ষায় পাশ করেছেন মাত্র ৪৬ জন। এখনো বাকী মৌখিক পরীক্ষা। প্রশ্ন উঠেছে, মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়লে পদ পূরণ হবে কোন উপায়ে?এমন প্রশ্নের জবাব বিমান কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।তবে অনেকেই বলছেন, মৌখিক পরীক্ষায় পাস ফেল যাই করুকনা কেন তাদের প্রত্যেককেই নিয়োগ দিয়ে দেয়া হবে। এরপরও বাকী থাকে ১৪ জন। পরীক্ষার আগেই এই ১৪ জনকে ঠিক করে রেখেছে সংশ্লিষ্টরা।
এই নিয়োগ কেলেংকারীর সঙ্গে একজন প্রভাবশালী পর্ষদ সদস্যের ইন্ধন রয়েছে। খোদ বিমানেরই একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, তিনি আগামী পর্বে বিমানের চেয়ারম্যান হতে আগ্রহী’।
বিমানের গুরুত্বপূর্ন বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকতে পরীক্ষা গ্রহণের দায়িত্ব অন্যদের হাতে হস্তান্তর করা হল। এটা কি বিমানের কর্তৃপক্ষের প্রতি অযোগ্যতা ও অবিশ্বস্ততার পরিচয় বহন করেনা? এ প্রশ্ন অনেকের? এমন ঘটনাও ঘটছে নিয়োগ পত্রে উল্লেখিত চাহিদার কমসংখ্যক প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করে ফলাফল পাঠানো হয় এর কারণ বিমান কর্তৃপক্ষেরও অজানা।
জানা যায় বিমানের একজন প্রভাবশালী পর্ষদ সদস্য বিমান প্রশাসন শাখার তারই একজন ঘনিষ্ট কর্মকর্তা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক অনুষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে এধরনের একটি তুঘলকি নিয়োগ কেলেংকারীর জন্ম দিয়েছেন। এরই মধ্যে পাইলট ও এয়ারক্রাফট মেকানিক পদে নিয়োগেরও প্রস্তুতি চলছে।
বিমানের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল ইনামুল বারী বলেন, হয়তো পরীক্ষা পদ্ধতিতেই ত্রুটি ছিল। সূত্র জানায়, বিমানের ভেতর ও বাইরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এই নিয়োগ কেলেংকারিতে জড়িত। অবস্থা এতটাই শোচনীয় বিমানের এমডিও অনেকটা অসহায় এ চক্রের সামনে’।
বিমানের অনিয়ম নতুন নয়। ৩১ডিসেম্বর ২০১৪ ইং তারিখের দৈনিক প্রথম আলোয় শিরোনাম হয়েছিল, অভিজ্ঞ ১৭ কেবিন ক্রুকে চাকরি দেয়নি বিমান। এতে লিখেছে, বিভিন্ন বেসরকারী এয়ারলাইন্সে কর্মরত এবং পরবর্তী সময়ে বিমানে প্রশিক্ষণ নিয়ে সাময়িক চাকরি করা ১৭ জন কেবিন ক্রুকে চাকরি দেয়নি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে প্রশিক্ষণে মেধা তালিকায় শীর্ষস্থানে থাকা ও দক্ষতার জন্য বিমানের সনদ পত্র পাওয়া ব্যক্তিরাও রয়েছেন। তাদের অভিযোগ ঘুষ দিতে না পারায় তাদের চাকরি দেয়া হয়নি।
বিমানের একটি সূত্র জানায় কেবিন ক্রু নিয়োগে বিমানের চেয়ারম্যানের কথিত ধর্মপুত্র মাহমুদুল হক ওরফে পলাশ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিমানের ফ্লাইট পরিচালক শাখার সাবেক একজন পরিচালক।’
বিমান যেনো এক অদৃশ্য, প্রেত সিন্ডিকেটের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানেও হয়ত এই প্রেত সিন্ডিকেটই পরিকল্পিত যান্ত্রিক ত্রুটি সৃষ্টি করেছিল। অভিযুক্তরা কোন সরকারের আমলে নিয়োগ পেয়েছিল? তাদের বায়োডাটা ও নিয়োগ প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নেয়া উচিত। আর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মত স্পর্শকাতর জায়গায় কেন অস্থায়ী নিয়োগ দেয়া হয়?
অস্থায়ী নিয়োগ প্রাপ্তদের কর্মে দায়বদ্ধতা কি শতভাগ থাকে? আর যে নিয়োগ গুলো মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয় তার অনিয়মের দায় তো মন্ত্রণালয়ের উপর বর্তানোর কথা নয়। এবিষয়টা ফায়সালা না করলে সরকার বদল হবে,মন্ত্রী বদল হবে কিন্তু সমস্যা থেকেই যাবে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কয়েকজন চাকরিচ্যুত হল।কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে রিমান্ডে গেল। কিন্তু এতে কি বিমান প্রেত সিন্ডিকেটের প্রভাব মুক্ত হবে? শেকড়ের খোঁজ না নিয়ে ডালপাতা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলে কী লাভ।এইসব কর্মকর্তা কর্মচারীরা কখন কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ হল। যোগ্য, দক্ষ ও প্রশিক্ষিতরা চাকরি পায় না, পায় অদক্ষ, অযোগ্য ও অপ্রশিক্ষিতরা।
এখানে ক্যাজুয়েল ভিত্তিতে লোক নিয়োগ হয়। নিয়োগে উল্লেখ থাকে ১০দিন, ৮৯দিন প্রভৃতি মেয়াদ ভিত্তিক নিয়োগ। মেয়াদ উত্তীর্ন হওয়ার পরেও তারা চাকরি করতে থাকে নতুন মেয়াদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই। ট্রাফিক হেল্পার ও কার্গো হেল্পার হিসাবে কর্মরতরা রোজ ঠিকে মজুরের মত। তাদের ছুটি বলে কিছু নেই। অনুপস্থিতি হলে বেতন কর্তন করা হয়। তাদের তদারকির দায়িত্বে থাকেন একজন হেড হেল্পার। ট্রাফিক হেল্পারদের মধ্যে যারা বিমান হতে হুইল চেয়ারে যাত্রী উঠা-নামার দায়িত্ব নিতে চায় তাদের প্রতিদিন হেড হেল্পারদের ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। তখন ট্রাফিক হেল্পাররা বাধ্য হয় যাত্রীদের নিকট হতে বখশিস নিতে।
জানা যায় ১০দিন ভিত্তিক অস্থায়ী ভাবে ঢুকে জীবন পাড় করে দেয় ক্যাজুয়েল ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারীরা। চাকরি শেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। চাকরির নিশ্চয়তা,পেনশন এসব তাদের নেই। প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক ক্যাজুয়েল হিসাবে কাজ করে আসছে। তাদের মধ্যে অনেকেই রয়েছে ভুঁয়া কাগজধারী। ক্যাজুয়েল কার্গো হেল্পার ও ট্রাফিক হেল্পারদের প্রাণের দাবী তাদের চাকরির স্থায়ীকরণ। তাদের প্রত্যাশা তাদেরকে বিমান মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভূক্ত করা হোক। কিন্তু তাদের মন্ত্রণালয়ের বাইরে ক্যাজুয়েল হিসাবেই টিকিয়ে রাখতে চায় বিমানেরই কিছু অসাধু চক্র। কারণ ক্যাজুয়েলরাই হয় তাদের অবৈধ টাকা রুজীর বাহন।
কার্গো হেল্পার ও ট্রাফিক হেল্পার ছুটিতে থাকলে তাদের একশ্রেনীর কর্মকর্তা বলে, তোমার দশদিনের ছুটির ৫দিনের বেতন যদি আমাকে দাও হাজিরা খাতায় তোমার উপস্থিতি দিয়ে দেব। তুমি তখন বেতন উঠাতে পারবে। অনেকেই তাদের এই অনৈতিক প্রস্তাব মেনে নেয়।কাজ ফাঁকি দিয়ে অনেকেই এভাবে বাইরে ব্যবসা বাণিজ্য করে আর মাস পেরোলে বেতন উঠায়।
আরও আছে সিবিএ নেতাদের ধান্ধাবাজী। কোন হেল্পার যদি কোন যাত্রীর লাগেজ নামিয়ে দিয়ে কোন বখশিশ নেয়। সেটা পুলিশের নজরে এলে হেল্পারের কার্ড জব্ধ করা হয়। তখন এগিয়ে যায় সিবিএ নেতারা হেল্পারদের বলে ৪০০০০/৫০০০০টাকা দাও। বিষয়টা ফায়সালা করতে হবে না হয়ত চাকরি হারাবে। তখন হেল্পাররাও বাধ্য হয়ে সিবিএ নেতার সাথে আর্থিক সম্পর্ক করে। এটাকা তখন ভাগাভাগি হয় সিন্ডিকেটে।
নিয়োগ প্রক্রিয়ারও কোন স্থায়ী পদ্ধতি নেই।মাঝে মাঝে লিখিত পরীক্ষা হয় মাঝেমাঝে হয় না। ক্যাজুয়েলদের মধ্যে কেউ লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষা দিয়ে এসেছে, কেউ এসেছে শুধু ভাইবা দিয়ে। আবার কেউ কোনটাই দেয়নি এমন কথাও শোনা যায়। ক্যাজুয়েল ট্রাফিক হেল্পার ও কার্গো হেল্পারদের মধ্যে এসএসসি হতে বিএ পাশ যুবক রয়েছে। আর তাদের সর্দারের ভূমিকায় থাকা হেড হেল্পারদের মধ্যে বেশির ভাগই নন ম্যাট্রিক। তারা ট্রাফিক হেল্পার ও কার্গো হেল্পারদের সাথে চরম দূর্ব্যবহার করে থাকে।
হেল্পারদের সাথে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলেন, আমরা যেন ক্রীতদাসের মত। যেকোন সময় আমাদের পরিচয় পত্র নিয়ে যেতে পারে।পরিচয় পত্র কেড়ে নিলেই আমাদের চাকরি শেষ। ব্যাগেজ এরিয়ায় হেল্পারদের জন্য ব্যবহৃত বাথরুম গুলো চরম দুর্গন্ধ যুক্ত। হেল্পাররা নাকে রুমাল বেঁধে বাথরুমে ঢুকে।’আরও জানা যায়,প্রেত সিন্ডিকেট তাদের পছন্দের লোককে চাকরি দিতে যখন তখন বিমান কর্তৃপক্ষকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিতে বাধ্য করে। এসব নিয়োগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরও কোন কর্তৃত্ব থাকে না। কারণ এগুলো মন্ত্রণালয়ের অধীন নয়। এজন্য মন্ত্রীর নির্দেশও গুরুত্ব দেয় না এই প্রেত সিন্ডিকেট।
এর এই চরম ক্ষমতার উৎস কী। তা খতিয়ে না দেখে শুধু অনিয়ম অনিয়ম বলে চেঁচালে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বিমানে কর্মরত কর্মকর্তাদের সকলেই অসৎ বিষয়টা তা নয়। সৎরাও অসহায় প্রেত সিন্ডিকেটের প্রেতালো থাবায়। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদও পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। এসব তথ্যের পাল্টাপাল্টি তথ্যের সত্যতা উদঘাটন করা জরুরি। সত্যিকারের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর নিরাপরাধ প্রেত সিন্ডিকেটের ষড়যন্ত্রের শিকারদের অব্যাহতি দিতে হবে।
সরিষায় ভূত রেখে শুধু তদন্ত কমিটি গঠন করলে হবে না। একই পদে ঘন ঘন নিয়োগ না দিয়ে চাহিদা ও বিধিমাফিক অধিকসংখ্যক জনবল চেয়ে কম সংখ্যক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলেইত হয়। অস্থায়ী নিয়োগ প্রথা বাতিল না করলে অদক্ষ,অসৎ ও ষড়যন্ত্রকারীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ হবে না। ২০/৩০ বছর ধরে স্থায়িত্নের আশায় থেকে হাঁফিয়ে ওঠে অনৈতিক পথে পা বাড়ায় অনেকেই। চাকরি শেষে খাবে কী, কীভাবে সংসার চালাবে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে গিয়ে। তখন অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অনেককে চাকরি ছেড়ে চলে যেতেও দেখা যায়। অস্থায়ী নিয়োগ বন্ধ করা ও বিমানে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আগে নিয়োগ দেয়া অস্থায়ী পদগুলোকে স্থায়িত্ব প্রদান করা জরুরি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ক্যাজুয়েল হেল্পারের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের দূর্গতির কাহিনী। তারা বলেন , আমাদের কোন ছুটির দিন নেই। অফ ডে ও অনুপস্থিতে আমাদের বেতন নেই। গার্মেন্টস কর্মীদেরও সাপ্তাহিক ছুটি আছে আমাদের নেই। আমাদের কোন নিয়োগ পত্রও দেয়া হয় না।
তারা বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নই। বিমান লিমিটেডের অধীনে। ক্যাজুয়েল ডি মন্ত্রনালয়ের বাইরে ক্যাজুয়েল সি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আমরা ক্যাজুয়েল ডি। মন্ত্রণালয়ের অধীনে যারা তারা সকল প্রকার সরকারি সুবিধাদী পায়। আমরা কাজ করতে গিয়ে পঙ্গু হয়ে গেলেও এর দায়ভার বিমান লিমিটেড নেয় না। অামাদের দাবী অস্থায়ী ভিত্তিক চাকরির স্থায়ীকরণ ও মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভূক্তি। বর্তমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন শ্রমজীবী মানুষের সংগঠনের নেতা। আমরা তার মাধ্যমে এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের দাবী জানাই।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)