গত ৫ মে ছিল বিপ্লবের প্রতীক প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর ১০৬তম জন্মবার্ষিকী। মাস্টারদা সূর্য সেনের এই সহযোগী ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তিনি জীবন বিসর্জন দেন।
৬ মে প্রীতিলতা ট্রাস্ট এবং ভোরের কাগজের যৌথ উদ্যোগে প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদার এর একশো ছয়তম জন্মবার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে বিপ্লবী এই নারীকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, ‘প্রীতিলতা কে নিয়ে সিনেমা তৈরী হয় কেন? এমন কথা অনেকবার ভেবেছি। এমন বহুমাত্রিক একটি চরিত্র! দস্যুরানী কিংবা রানী কেন ডাকাত নামে জনপ্রিয় ছবিও তো তাঁকে নিয়ে হতে পারতো। কেননা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর ডাক নাম তো ‘রানী’-ই। সামাজিক এ্যাকশান নামে প্রধান যে জঁরার চলচ্চিত্র তৈরী হয় এফডিসিতে, সেও তো তাঁরই জীবন, সামাজিক-এ্যাকশানও বলা যায় সেই জীবনকেই। এরকম সত্যিকারের নায়িকা কিংবা shero দের বাদ দিয়ে চলচ্চিত্রের পর্দাও জীবনবিমুখ।
গতবছর থেকেই শুনছিলাম, প্রীতিলতার জন্মদিনে এবছর তাঁর জীবনের সূত্র ধরে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা এসেছে। পোস্টারও দেখছি ঢাকা শহরের রাস্তায়। Wanted বলে হুলিয়া জারি করার সেই পোস্টার দেখে ভাবছি, প্রীতিলতাকে সত্যিই খুঁজে পাওয়া হোক। ঘরে ঘরে যাক হুলিয়া।
প্রীতিলতার জন্মদিন ছিল ৫ মে, ১৯১১ সাল। আর ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে মাত্র বাইশ বৎসর বয়সেই তিনি জীবন বিসর্জন দেন। প্রীতিলতা আসলে একজন বহুমাত্রিক প্রথাবিরোধী সংগ্রামী। একজন Role Model। যার ভূমিকা অনুসরণযোগ্য।
রোল-মডেল বা অনুসরণ করার মতো কেউ সামনে থাকা অত্যন্ত দরকার। প্রীতিলতারও ছিল। ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রিয় ইতিহাস শিক্ষক ঊষাদি তাঁকে ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাই-এর গল্প বলেন, বইটি পড়তেও দেন।
পুরুষের পোষাক পরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন যে ঝাঁসীর রাণী , তা প্রীতিলতার মনে যে ছাপ ফেলে, তা ব্রিটিশ বিরোধী আর এক যোদ্ধা কল্পনা দত্তের লেখা থেকে জানা যায়। কল্পনা দত্ত ছিলেন একই স্কুলে, এক ক্লাস উপরে। তাঁদের স্বপ্নের কথা লিখেছেন কল্পনা দত্ত – কোন কোন সময় আমরা স্বপ্ন দেখতাম বড় বিজ্ঞানী হব। সেই সময়ে ঝাঁসীর রানী আমাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে। নিজেদেরকে আমরা অকুতোভয় বিপ্লবী হিসাবে দেখা শুরু করলাম।
নারীর জন্য বিপ্লবী হওয়ায় সহজ ছিল না কিন্তু। মনে করা হতো, বিপ্লব হচ্ছে নারীচরিত্র বিবর্জিত। বিপ্লবী পূর্ণেন্দু দস্তিদার, প্রীতিলতার দাদাস্থানীয় ছিলেন। তাঁর কাছে প্রীতিলতা বিপ্লবী সংগঠনে যোগদান করার গভীর ইচ্ছার কথা বলেন। কিন্তু তখনো পর্যন্ত বিপ্লবীদলে মহিলা সদস্য গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কোন মেয়েদের সাথে মেলামেশা করাও বিপ্লবীদের জন্য নিষেধ ছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর প্রথাগত চিত্র আঁকা হয় একজন সাহায্যকারিনী হিসেবে। অথচ প্রীতিলতা নিজেই ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন তাঁর শেষ যুদ্ধে। পাহাড়তলীর যে ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ চালানো হয়, এই ক্লাবটিতে একটি সাইনবোর্ড লাগানো ছিলো যাতে লেখা ছিল কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনই শুধু নয়, জাতিঘৃণার একটি কদর্য বহিঃপ্রকাশ ছিল এখানে। প্রীতিলতার দলটি ক্লাবটি আক্রমণ করে। ফিরে যাবার পথে শেষমূহুর্তে গুলি লাগে প্রীতিলতার গায়ে। পুলিশের হাতে আটক এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এই নায়িকা তো কোন দিকেই তো পিছিয়ে ছিলেন না কখনো। মেধাবী শিক্ষার্থী। স্কলারশিপ পেতেন, লেটার পেতেন, মেধা তালিকায় স্থান করে নিতেন, নাটক লিখতেন, বাঁশি বাজাতেন, এস্রাজ বাজাতেন। স্কলারশিপ পাওয়ার জন্যই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েটি প্রায় একশো বছর আগে ইডেন কলেজে আই এ এবং বেথুনে গিয়ে বিএ পড়তে পারেন। বিএ পড়ার দিকেই আগ্রহ ছিল তার, বিয়ে করার দিকে নয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের চেষ্টাও নেওয়া হয়েছিল, তাঁর প্রবল আপত্তির কারণেই বিয়ের ব্যবস্থা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়।
তার মানে শিক্ষা থেকে ব্যক্তিগত জীবন, সংস্কৃতি থেকে বিপ্লব সবখানে তিনি গেযেছেন শেকল ভাঙার গান। দেখিয়েছেন সীমা অতিক্রমের সাহস। গানে, গল্পে-গাঁথায়, চলচ্চিত্রে, সকল প্রকাশে তাঁর রোল মডেল চোখের সামনে থাকুক। বার বার মনে হোক তাঁর কাছে পাওয়া নিজের হাতে লেখা বিবৃতির শেষ স্তবকে কী কথা বলে তিনি আত্মাহুতি দিয়েছেন- নারীরা আজ কঠোর সংকল্প নিয়েছে যে, আমার দেশের ভগিনীরা আজ নিজেকে দুর্বল মনে করিবেন না। সশস্ত্র ভারতীয় নারী সহস্র বিপদ ও বাধাকে চূর্ণ করিয়া এই বিদ্রোহ ও সশস্ত্র মুক্তি আন্দোলনে যোগদান করিবেন এবং তাহার জন্য নিজেকে তৈয়ার করিবেন- এই আশা লইয়াই আজ আত্মদানে অগ্রসর হইলাম।।
(স্বাক্ষর) প্রীতিলতা ওয়াদ্দাদার ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ ইং
গতকাল ৬ মে প্রীতিলতা ট্রাস্ট এবং ভোরের কাগজের যৌথ উদ্যোগে প্রীতিলতা ওয়েদ্দাদার এর একশো ছয়তম জন্মবার্ষিকী পালিত হলো। খেলাঘরের নতুন প্রজন্ম গানে গানে মনে করালো, বিপ্লবের মৃত্যু নেই। বিপ্লবীর মৃত্যু নেই।’