বয়স তার ৩৬ ছুঁই ছুঁই। আগামী বিশ্বকাপ ২০২৩ সালে। সেখানে মাশরাফীর খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সেটি নিজেও খুব ভালো করে জানেন তিনি। তাই তো দেশ ছাড়ার আগেই তিনি বলেছেন, এবারের আসরই আমার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মাশরাফীর শেষ বিশ্বকাপটা রঙিন হলো না!
কিন্তু বিশ্বকাপ মিশন শেষ হওয়ার আগে আকস্মিকই মাশরাফীকে নিয়ে নানা কানাঘুষা শুরু করা হলো। তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তাকে ছাড়াই বাংলাদেশ শেষ ম্যাচ খেলতে নামছে। পারফরম্যান্সের কারণেই নাকি তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, এমন নানা গুজব রটানো হলো।
ভারত ম্যাচের পর মাশরাফী সংবাদ সম্মেলনে আসেননি। পাকিস্তান ম্যাচের আগেও একই চিত্র। এমনকি শেষ দিনের অনুশীলনেও তাকে দেখা যায়নি। এসব ঘটনার সঙ্গে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে শেষ ম্যাচের আগেই মাশরাফীর অবসর নিয়ে এক শ্রেণির মানুষের আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়। কিন্তু কেন? ৮ ম্যাচ দিয়েই ১৮ বছরের একজন ক্রিকেটার, যিনি ১৪ বছর একাই (রাসেল, নাজমুল, শাহাদাত কিছু সময় পাশে ছিলেন) দেশের পেস বোলিংকে বিশ্ব ক্রিকেটে টেনেছেন, তার জন্য একটা ম্যাচ পর্যন্ত কি অপেক্ষা করা যেত না?
লর্ডসের মত জায়গায় বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নেতাকে অবসর গ্রহণের সুযোগটা করে দিতে অনেকের মধ্যে এত কার্পণ্য কেন? এটা কোন ধরনের হীনতা? এ্ই বিশ্বকাপে র্যাংকিংয়ে নীচের কোনো দলের কাছে বাংলাদেশ হারেনি। র্যাংকিংয়ের উপরের একটা দলকে হারিয়েছে। আরও একটাতে জয় ছুঁই ছুঁই দুরত্বেই ছিল টাইগাররা। তা হলে মাশরাফীকে নিয়ে এত জ্বালা কেন?
একথা ঠিক যে এবারের বিশ্বকাপে মোটেও ভালো সময় কাটেনি মাশরাফীর। ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে এবারের মতো বাজে সময় খুব কমই এসেছে তার ক্যারিয়ারে। ৭ ম্যাচের মাত্র একটিতে নিয়েছেন ১ উইকেট। ১০ ওভার শেষ করেছেন মাত্র একবার! অথচ বিশ্বকাপের আগেও ছিলেন সেরা ছন্দে। সেজন্য অবশ্য হ্যামস্ট্রিং চোটও অনেকটাই দায়ী।
এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, আজকের ম্যাচের পরই বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নেতৃত্ব থেকে, বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছেন ক্রিকেটের এই মহানায়ক। কিন্তু তার বিদায়ের পর্বটা ভালো হলো না। এক শ্রেণির নেতিবাচক মানসিকতার মানুষই তার বিদায়পর্বটাতে সমালোচনার কালি লেপ্টে দিলেন!
তার কোনো দরকার ছিল না। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রেখেছিলেন মাশরাফী-বাহিনী। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদের তাড়া করে ফিরেছে। হাত-ফস্কে ক্যাচ মিস, দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়ারদের হঠাৎ ইনজুরি, বৃষ্টিতে পয়েন্ট নষ্ট, জয়ের কাছে গিয়েও হেরে যাওয়া- দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছুই নয়। এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ভাগ্যের সহায়তা পায়নি। আর তাইতো সেমিফাইনালের স্বপ্নপূরণ হয়নি।
যারা মাশরাফীর সমালোচনা করছেন, তারা হয়তো ভুলে গেছেন, পায়ে সাতটি অস্ত্রোপচার নিয়ে এখনও ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন তিনি। অধিনায়কত্ব, বোলিং দিয়ে দলকে সেরা অবস্থানে আনতে বড় ভূমিকা ছিল তার। ২০১৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের যখন টালমাটাল অবস্থা, তখনই দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন তিনি।
২০১৫ বিশ্বকাপের আগে দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচ সিরিজে ওয়ানডে অধিনায়ক হন মাশরাফী। দায়িত্ব নিয়ে দলকে পাল্টে দেন তিনি। জিম্বাবুইয়ানদের বিপক্ষে ৫ ম্যাচের সবই জয় পায় বাংলাদেশ। এ সাফল্য নিয়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিশ্বকাপে খেলতে নামেন টাইগাররা।
সেই আসরে বড় কোনো লক্ষ্য ছিল না বাংলাদেশের। কিন্তু মাশরাফীর নেতৃত্বে বিশ্বকাপের মঞ্চে সেরা সাফল্যই পান লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। গ্রুপপর্ব পেরিয়ে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে প্রথমবারের মতো খেলেন তারা।
শেষ আট থেকে বিদায় নিলেও থেমে যায়নি বাংলাদেশের পথচলা। মাশরাফীর নেতৃত্বে এর পর ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে নাকানিচুবানি দেন তারা। এসব সাফল্যে আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ৭ নম্বরে উঠে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে সরাসরি খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
সেখানে চমক দেখান টাইগাররা। দলের খেলোয়াড়দের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স, মাশরাফীর বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে সেমিফাইনালে ওঠে। কিন্তু সেখানেই থেমে যায় জয়যাত্রা। বিশ্বকাপ ও চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সাফল্যে দলকে আরও বড় স্বপ্ন দেখান কাপ্তান। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার পণ করে দেশ ছাড়েন তিনি।
কিন্তু না, ভাগ্য সহায় হয়নি দলের। ভাগ্য সহায় হয়নি মাশরাফীর। নয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি বিশ্বকাপের মঞ্চে মাত্র ১ উইকেট পাবেন, বেমানানই বটে! ক্রিকেটে মন্দ সময় সবারই আসে। মাশরাফীরও এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষ তাকে নিয়ে কটূ সমালোচনাটা একটু যেন বেশিই করছে। যা মোটেও সঙ্গত নয়। এটা এক ধরনের অকৃতজ্ঞতাও বটে!
২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নামেন মাশরাফী। ৯ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ে প্রধান ভূমিকা ছিল তার। ৯.৩ ওভারে ৩৮ রান দিয়ে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলা মাশরাফী ২০১১ সালের বিশ্বকাপ মিস করেন। দেশের মাটিতে ওই মেগা ইভেন্টের জন্য দল ঘোষণার এক মাস আগে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার সময় আবারও হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন তিনি। তাই তাকে ছাড়াই দেশের মাটিতেই বিশ্বকাপ খেলতে হয় বাংলাদেশকে।
তবে অধিনায়ক হিসেবে ২০১৫ বিশ্বকাপ খেলেছেন মাশরাফী। ৫ ম্যাচে অংশ নিয়ে ৭ উইকেট নিয়েছেন দলের নেতা। এর পর এখন পর্যন্ত ৭২ ম্যাচে ৭৬ উইকেট নিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয়বার অধিনায়ক হওয়ার পর দলনায়ক হিসেবেও দেশকে এনে দিয়েছেন বড় বড় সাফল্য। বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা অধিনায়ক বনে যান তিনি। ৮৪ ম্যাচে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ৪৭টি জয় পেয়েছেন ম্যাচ, হার ৩৫টি।
বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মহানায়কের বিদায়ী ম্যাচটি স্মরণীয় হোক এই কামনাই করি।
পুনশ্চ: বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বমানে পৌঁছে দিতে মাশরাফীর অবদান অনন্য। মানুষ হিসেবেও মাশরাফী অসাধারণ। তিনি ক্রিকেটকে দেখেন বিনোদনের একটি মাধ্যম হিসেবে। দেশের মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ডাক্তার, বিজ্ঞানী, কৃষক-শ্রমিকদের যিনি ক্রিকেটারদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে স্থান দেওয়ার ঔদার্য দেখান!
বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সফল অধিনায়ক মাশরাফীর বিন মুর্তজার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করতে চাই:
‘দেশের তুলনায় ক্রিকেট অতি ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার। একটা দেশের অনেক ছোট ছোট মাধ্যমের একটা হতে পারে খেলাধুলা; তার একটা অংশ ক্রিকেট। ক্রিকেট কখনও দেশপ্রেমের প্রতীক হতে পারে না। সোজা কথায়-খেলাধুলা হলো বিনোদন’।
‘খেলা কখনও একটা দেশের প্রধান আলোচনায় পরিণত হতে পারে না। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে যা সমাধান বাকি। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে পুরো জাতি, রাষ্ট্র এভাবে এনগেজ হতে পারে না। ’
‘আমি ক্রিকেটার, একটা জীবন কি বাঁচাতে পারি? একজন ডাক্তার পারেন। কই, দেশের সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের নামে কেউ তো একটা হাততালি দেয় না! তাদের নিয়ে মিথ তৈরি করুন, তারা আরও পাঁচজনের জীবন বাঁচাবেন। তারাই তারকা। তারকা হলেন লেবাররা, দেশ গড়ে ফেলছেন।
ক্রিকেট দিয়ে আমরা কী বানাতে পারছি? একটা ইটও কি ক্রিকেট দিয়ে বানানো যায়? একটা ধান জন্মায় ক্রিকেট মাঠে? যারা ইট দিয়ে দালান বানায়, কারখানায় এটা-ওটা বানায় বা ক্ষেতে ধান জন্মায়, তারকা হলেন তারা’।
‘বীর হলেন মুক্তিযোদ্ধারা। আরে ভাই, তারা জীবন দিয়েছেন।
জীবন যাবে জেনেই ফ্রন্টে গেছেন দেশের জন্য। আমরা কী করি? খুব বাজে ভাবে বলি–টাকা নেই, পারফর্ম করি। একটা অভিনেতা, গায়কের মতো পারফর্মিং আর্ট করি। এর চেয়ে এক ইঞ্চি বেশিও না। মুক্তিযোদ্ধারা গুলির সামনে এইজন্য দাঁড়ায় নাই যে জিতলে টাকা পাবে। কাদের সঙ্গে কাদের তুলনা রে!’
‘কিছু হলেই আমরা বলি, এই ১১ জন ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধি। আন্দাজে! তিন কোটি লোকও হয়ত খেলা দেখেন না। দেখলেও তাদের জীবন-মরণ খেলায় না। মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন রাজনীতিবিদেরা, তাদের স্বপ্ন ভবিষ্যৎ অন্য জায়গায়। এই ১১ জন মানুষের ওপর দেশের মানুষের ক্ষুধা, বেঁচে থাকা নির্ভর করে না। দেশের মানুষকে তাকিয়ে থাকতে হবে একজন বিজ্ঞানী, একজন শিক্ষাবিদের দিকে!’
(মাশরাফী বিন মুর্তজার সাক্ষাৎকারভিত্তিক আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাশরাফি’ থেকে, গ্রন্থনা: ক্রীড়া সাংবাদিক দেবব্রত মুখোপাধ্যায়)।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)