কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন একটি সংকটময় মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। এ মহামারি নিম্ন আয়ের মানুষকে অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করেছে। দেশের প্রায় ১০ কোটি ২২ লাখ (১০০.২২ মিলিয়ন) মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিবারের উপার্জন কমে গেছে। চৌদ্দ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বা ফিরে আসছেন।
ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে।
‘কোভিড-১৯ এবং জাতীয় বাজেট ২০২০-২০২১: নিম্নআয়ের মানুষের জন্য কৌশল পুনর্বিবেচনা’ শীর্ষক এই সমীক্ষার ফলাফল সোমবার এক ডিজিটাল সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান।
ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কেএএম মোর্শেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন আইসোশ্যাল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. অনন্য রায়হান। প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।
সমীক্ষাটিতে ব্র্যাক, বিআইজিডি, পিপিআরসি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত গবেষণা-সমীক্ষার পর্যালোচনার পাশাপাশি একটি জরিপও পরিচালনা করা হয়েছে এবং প্রাপ্ত ফলাফল সমন্বয় করে মূল প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। জরিপটি দেশের ২৫ জেলায় দৈবচয়নে নির্বাচিত ৯৬২ জন উত্তরদাতার অংশগ্রহণে মে মাসের ১৫-১৮ তারিখের মধ্যে সম্পাদন করা হয়।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায় দেশে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৩৬ লাখ (৫৩.৬৪ মিলিয়ন) মানুষ চরম দরিদ্র (দৈনিক আয় ১.৯ ডলার)। এদের মধ্যে নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারগুলোও রয়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা চরম দরিদ্রের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৩ লাখ (৪৭.৩৩ মিলিয়ন) এবং উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন ৩ কোটি ৬৩ লাখ (৩৬.৩৩ মিলিয়ন)মানুষ।
জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে নিম্নআয়ের মানুষের উপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এর মধ্যে ৩৪.৮% পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন প্রায় ৭৪% কমে গেছে। দিনমজুরসহ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উৎপাদন খাতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। উদাহরণ হিসেবে, তৈরিপোশাক খাতে রফতানি এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪% হ্রাস পেয়েছে। এ বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ই এপ্রিলের মধ্যে ১,১১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষিত হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক (২.১৯ মিলিয়ন) শ্রমিক।
সমীক্ষায় আরো জানা যায়- নিম্নআয়ের মানুষের এই রোগের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যের মৃত্যু হলে নারী ও শিশুদের মধ্যে অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হওয়ার উচ্চ আশঙ্কা সৃষ্টি হবে।
দেশব্যাপী সমন্বয়ের অভাবের কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের কাছে সরকারের দেওয়া খাদ্য এবং নগদ সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণা-সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয়।
কোভিড-১৯ নতুন অর্থনৈতিক বিভাজন, সামাজিক বিভাজন এবং ডিজিটাল বিভাজন সৃষ্টি করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেবল ৩৪% পরিবারের স্মার্টফোন রয়েছে এবং ৫৪% পরিবারের টিভি দেখার সুযোগ রয়েছে। অতএব, এর নিচের অংশে বসবাসকারী শিশুরা ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে।
চৌদ্দ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারানোর কারণে ফিরে এসেছেন বা দেশে ফিরে আসছেন। বিদেশে থাকা অভিবাসীরাও এখন ঋণচক্র ও সামাজিক কলঙ্কের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়েছেন।
কোভিড-১৯ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাঁদের পরিবারগুলোকে আরও বেশি অসুবিধার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে, তারপর স্বপ্নপূরণ আর সুখে থাকার চিন্তা। তাই এবারের বাজেট হোক বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার বাজেট। কোভিড-১৯ এর এই মহামারিতে সবচেয়ে হুমকির মুখে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মধ্যবিত্তরাই চিকিতসাসেবা পাবেন কি না সেই আতঙ্কে আছেন, দরিদ্রদের অবস্থা তো আরও করুণ। স্বাস্থ্যখাত ঠিক না করলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের অর্থনীতিও আগাবে না।’
ড.নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে বটম অফ দি পিরামিডে শুধু শ্রমিকেরা নয়, অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও আছেন। প্রণোদনা দেওয়ার পরেও শ্রমিকদের ৬০% বেতন দেওয়া হয়েছে। তাদের বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ তো কমেনি। তাই এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য যাদের প্রয়োজন বেশি তাদের প্রণোদনা বা ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। এখন অনলাইন ব্যবসায়ের উদ্যোক্তা বেড়েছে। তাই স্মার্ট ফোন সুলভ করে ইন্টারনেট খরচ কমাতে হবে।’
ড. ইমরান মতিন বলেন, ‘জনগণের আতঙ্ক স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। উপজেলা ও গ্রামীণ পর্যায়েও সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম রাখতে হবে।‘
সভাপতির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এখন নতুন তালিকা তৈরির সময়ক্ষেপনের দিকে না গিয়ে আগের তালিকা ধরেই কাজ করা শ্রেয়। ৭৮ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে যে ১০০ তাকা করে বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে, তা এখনই ৫০০ টাকায় উন্নীত করা দরকার। এতে করে সঠিক জায়গায় সহায়তা পৌঁছানো অনেকটা নিশ্চিত হবে। শুধু বরাদ্দ করলেই হয় না, সবার কথা, সুবিধা-অসুবিধা শুনে দক্ষতাপূর্ণ, কার্যকর ও কৌশলী বাজেট করতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে হাঁটতে হবে।’
এই গবেষণার আলোকে জাতীয় বাজেট ২০২০-২০২১-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- নিম্নআয়ের যেসব পরিবারের উপার্জনকারী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে উপার্জনহীন হয়েছেন বা মারা গেছেন সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে অন্তত তিন বছরের জন্য নগদ সহায়তা প্রবর্তন করা। ২০২০-২০২১ অর্থবছর থেকে চরম দরিদ্র ও দরিদ্রদের জন্য এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছর থেকে অন্যান্য বেকার গোষ্ঠীগুলির জন্য সর্বজনীন বেকারত্ব সুবিধা স্কিম চালু করা।
সরকারি পরিষেবা ও সুবিধাগুলো নাগরিকদের কাছে সহজলভ্য করতে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে নাগরিকদের (বয়স নির্বিশেষে) সর্বজনীন পরিচয় ব্যবস্থা তৈরি এবং প্রবর্তন করা। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষা স্কিম, ঋণ, সঞ্চয় এবং বিমা ইত্যাদি সুবিধা পাওয়ার জন্য সকল নাগরিককে সর্বজনীন ডিজিটাল পরিষেবাদিতে অন্তর্ভুক্ত করা। জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য ১৬ বছরের বেশি বয়সী সমস্ত বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য পৃথক ডিজিটাল যন্ত্রাদিএবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট পরিষেবা চালু করা।
আয়ের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাকরি সৃষ্টি এবং ঋণচক্র ও সামাজিক কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে স্বদেশ ও বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি চালু করা। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সর্বোচ্চ সম্পদ বরাদ্দ করা এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা এবং সমন্বয় কার্যকর করা।
এ ছাড়া স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করতে ঘরে বসে অফিস এবং কিছু ক্ষেত্রে কর্মস্থলে গিয়ে কাজ এই উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয়কে উৎসাহিত করার প্রস্তাব রাখা হয়। একইসঙ্গে কারখানা ও অফিসগুলোর জন্য প্রতিদিন কাজের সময়সীমা ছয় ঘণ্টা করা এবং প্রয়োজনে তিনটি শিফ্ট চালু করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। এটা করা গেলে যানজট হ্রাস পাবে এবং অফিসে ও কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে যথাযথ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখায় সহায়ক হবে।