এ বছরের ২৬ জানুয়ারি দৈনিক সমকালের ‘চারমাত্রা’য় ছাপা হয়েছিল লেখাটি। ‘রক্তের টান’। লেখক ফরিদুর রেজা সাগর। স্বজনের জন্য রক্তের টান আসলে কী, লেখাটি তা নিয়ে। বেশ সরল ভাষায় লেখক বলে গেছেন নিজের জীবনের আবেগঘন এক মুহূর্তের কথা। লেখার বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তুলতে এর বিকল্প ছিল না।
লেখাটির কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি‘…আমার বাবা মারা যান কলকাতায়। আমরা খবর পেয়ে কলকাতা রওনা হলাম। কলকাতায় আমাদের সফরসঙ্গী মোহনা কোনো কথা বলতে শেখেনি তখনও। কোনো ভাষা বা শব্দও উচ্চারণ করে না। আমরা বাবার কবর খুঁজছি। এত বছর আগের কথা, এখনও কথাটি ভাবতে বসলে বিস্মিত হই, মানুষের মুখ যে কেমন আমূল পাল্টে যায়! কথাটি মনে এলে আমার মুখখানিও বদলে যায়। সেই কবরস্থানে যাওয়ার পর বিচিত্র এক ঘটনা ঘটে গেল।
যখন আমরা শেষমেশ কবরটা খুঁজে পেলাম, ঠিক তখনই, মোহনা জীবনের প্রথম শব্দ উচ্চারণ করল, দা- দা-। দা- দা-। এর আগে কোনো কথা বলা দূরে থাক, কোনো শব্দই উচ্চারণ করেনি মোহনা।
ও যে দাদার কবরে এসেছে, সবার আগেই বুঝে গেল। কেমন করে বুঝল?
আমরাও তখন ঠিকঠাক কারণটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, নিশ্চিত হওয়া তো পরের কথা। তবে আমাদের সবার মুখ, সবার অভিব্যক্তি এক লহমায় বদলে গেল ‘দা- দা-‘ কথাটি শুনে!’
বাসে বসে লেখাটি পড়ছিলাম। একবার পড়ার পর তৃপ্তি মিটলো না। আবার পড়লাম। আবার পড়লাম। অন্যরকম এক ঘোর তৈরি করেছিল ছোট্ট সেই লেখাটি। পর পর তিনবার পড়ার পর সংবিৎ ফিরল। লক্ষ্য করে দেখলাম, বাসটি গন্তব্যস্থল বিমানবন্দর পার হয়ে আব্দুল্লাহপুর এসে পৌঁছেছে।
আর একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সময় পেলেই নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকানে ঢু মারি। বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখি। ওদিন হাতের কাছে পেলাম ‘একজীবনে টেলিভিশন’ বইটি। লেখক ফরিদুর রেজা সাগর। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রার সময়কার অনেক ইতিহাস গল্পের ছলে বলে গেছেন লেখক। সচিত্র বইটিতে একটি সময়ের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু পড়ে একটুও মনে হচ্ছে না, কোনো ইতিহাস পড়ছি। কথাসাহিত্যের স্বাদ পাচ্ছিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বইটাতেই চোখ বুলিয়ে নিলাম। তখন মনে হয়েছে, দেশের টেলিভিশন জগতের কথা জানার জন্য এমন কাজ হয়নি বললেই চলে। ব্যতিক্রমী এই কাজটি যিনি করেছেন তার প্রতি হৃদয়ের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বোধ করলাম।
বহুমাত্রিক গুণের অনেক মানুষের কথা আমরা গল্প-উপন্যাসে পড়ি। কিন্তু বাস্তবে কজনের দেখা পাই? কিংবা আসলেই এমন বহুমাত্রিক গুণের মানুষ কজন আছেন? হাতেগোনা কয়েকজন। আমাদের সমকালীন শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের অন্যতম কিংবদন্তী ফরিদুর রেজা সাগর তাদের একজন। যেখানেই হাত দিয়েছেন, সোনা ফলেছে। হবেই না কেন? পারিবারিকভাবেই লালিত হয়েছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা দেখে দেখে। বাবা ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘সিনেমা’ এর সম্পাদক ফজলুল হক। যিনি দেশের প্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘প্রেসিডেন্ট’ নির্মাণ করেছিলেন। ওই ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে মূল চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। মা রাবেয়া খাতুন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল। আমাদের অন্যতম কথাসাহিত্যিক।
শৈশব থেকেই একটু একটু সমৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। বাবা-মায়ের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব তার শিশু মনে যে ইতিবাচক ছাপ ফেলেছিল, তা তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনই প্রমাণ দেয়। এত বড় মানুষ হওয়ার পরও তার মনটা শিশুদের মতো। কিশোর বয়স থেকেই শিশু সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। যুক্ত ছিলেন শিশু কিশোর সংগঠন কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা ও চাঁদের হাটের সঙ্গে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের যাত্রার সময় ১৯৬৫ সাল থেকেই তিনি শিশু কিশোর উপযোগী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। পরে নানা ধরণের অনুষ্ঠান পরিকল্পনা, গ্রন্থনা ও নির্মাণের সঙ্গে ছিলেন। বিচিত্র টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করেছেন দীর্ঘদিন।
কথাসাহিত্যে তার বিচরণের সিংহভাগই শিশুদের ঘিরে। তিনি শিশুদের মন বোঝেন। তার লেখায় তার প্রমাণ মেলে। শিশুরা তাকে কাছে পেলে যেমন আনন্দিত হয়, তার লেখা পড়ে শিহরিত হয়, তিনিও তেমন অকৃত্রিম স্নেহের আবেশে শিশুদের জড়িয়ে নিতে পারেন।
বর্ণাঢ্য এই কর্মজীবনের স্বীকৃতিও পেয়েছেন অঢেল। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক। শিশু সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি সম্মানিত হয়েছেন বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমির অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কারেও। ইউরো শিশু সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন গুণী এই মানুষটি।
লেখাটি শুরু করেছিলাম গণমাধ্যম ও শিশুসাহিত্যের নক্ষত্র ফরিদুর রেজা সাগরকে ঘিরে আমার ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি দিয়ে। শেষ করছি আমাদের নাট্যজগতের খ্যাতিমান নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর স্মৃতিচারণের অংশ বিশেষ দিয়ে।
‘ফরিদুর রেজা সাগর সবার জন্য করেন। সবাই তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তিনি জানেন না যাদের বিপদে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন তাদের কাছে তিনি কী, কেমন!…অনেক দিন বেঁচে থাকুক এই পরম প্রিয় মানুষটি। তাকে এই পৃথিবীর বড় প্রয়োজন। তার মতো মানুষ বিরল। তাকে আমাদের, এই প্রজন্মের বড় বেশি প্রয়োজন।’