যানজট এড়িয়ে সময়মত গন্তব্যে পৌছতে এবং পাবলিক যানবাহনের ভোগান্তি এড়াতে শিক্ষার্থীসহ শহুরে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাইসাইকেল।ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগের চেয়ে বিক্রিও বেড়েছে বাহনটির। আরও নির্বিঘ্নে নগরীর রাস্তায় যাতায়াতের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আলাদা লেনেরও দাবি করে আসছে বিভিন্ন সাইক্লিস্ট গ্রুপ।
রাজধানীসহ সারাদেশের জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর রাস্তায় সাইকেল আরোহীদের দেখা যাচ্ছে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি।কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা নিয়মীত ক্লাস এবং টিউশনসহ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করছেন সাইকেল। কর্মজীবীদের মধ্যেও ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পরিবেশবান্ধব দুই চাকার এ বাহনটি। ব্যবহারকারীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে অর্থও সাশ্রয় করে এ বাহনটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ঘুরে দেখা যায় প্রতিটি হলের নিচতলার প্রায় পুরোটাই সাইকেলে ঠাসা। ক্যাম্পাস শ্যাডো, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও বিজ্ঞান লাইব্রেরি বা কার্জন হল এলাকায় চোখে পড়বে সারি সারি সাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখা।
সাইকেল ব্যবহারের কারণ তুলে ধরে এমবিএ শিক্ষার্থী কিবরিয়া ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: প্রায় প্রতিদিনই আমাকে কোথাও না কোথাও যেতে হয়। ক্লাস না থাকলেও টিউশন থাকে। বা বইপত্র সহ নানা জিনিসপত্র কিনতে প্রায়ই শাহবাগ-নীলক্ষেত যেতে হয়। প্রথম রিক্সা পাওয়া কষ্টকর। তাছাড়া সুযোগ বুঝে তারা বেশি ভাড়া আদায় করে। ধরেন আমার হল(কবি জসীম উদ্দিন হল) থেকে নীলক্ষেতের দুরত্ব এক কিলোমিটাও হবে না। কিন্তু ভাড়া চেয় বসবে ৩০ টাকা। শাহবাগেও তাই। কিন্তু প্রতিদিন দুই/তিনবার যেতে আসতে যত টাকা ভাড়া লাগে অত টাকাতো আমার কাছে নাও থাকতে পারে।কিন্তু সাইকেলে গেলে আমারতো কোন খরচই হয় না।
নিজের খরচ নিজে চালাতে তিনি টিউশন করেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসান মো. জাহিদ।একাধিক টিউশন থাকায় প্রায় প্রতিদিনই তাকে যাতায়াত করতে হয়।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, আমি টিউশন করাই মীরপুরে। ক্যাম্পাস থেকে বেশ দূরে হওয়ার পরেও আমি সাইকেলেই যাতায়াত করি। এতে কষ্ট একটু বেশি হলেও আমার সময় ও অর্থ দুইই সাশ্রয় হয়। কারণ বাসে করে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা, ঠাসাঠাসি করে যাতায়াত করা এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকার চেয়ে সাইকেলে যাতায়াতই আমার কাছে স্বচ্ছন্দ মনে হয়।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় বাহন হিসেবে সাইকেলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
সাইকেলে ভরসা কর্মজীবীদেরও
সদ্য স্নাতকোত্তর শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন লায়লা নওশীন। প্রতিদিন বাইসাইকেলে করে আজিমপুরের বাসা থেকে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় তার অফিসে যাতায়াত করেন।
সময় এবং অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কথা তুলে ধরে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, শহরের যানবাহনগুলোর অবস্থাতো জানেনই। যানজটতো আছেই, অসহনীয় ভিড়ের কারণে নারীদের জন্য তা মোটেও নিরাপদ মনে হয় না আমার কাছে। তাই আমি সাইকেল চালিয়েই অফিসে আসি প্রতিদিন। তাতে অনেকে অনেক কথা বললেও আমি নিজেকে নিরাপদ মনে করি।
তবে যেস তরুণীরা সাইকেল ব্যবহার করছেন এবং যারা আগ্রহী তাদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ দিয়ে লায়লা নওশীন বলেন, নগরীর রাস্তায় চলাচলের জন্য জন্য তরুণীদের হেলমেট এবং হ্যান্ডগ্লোভস ব্যবহার করা জরুরি। এতে যেমন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তেমনি পথচারীদের টিজিংয়ের হাত থেকেও বাঁচা যায়।
প্রতিবাদেও সাইকেল
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্যও তরুণেরা সাইকেলকে ব্যবহার করছেন প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে।সর্বপ্রথম প্রতিবাদের উপকরণ হিসেবে সাইকেল ব্যবহার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদরল শিক্ষার্থী। অবিলম্বে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে গত আগস্টে। সর্বশেষ গত রোববার সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজধানীতে সাইকেল শোভাযাত্রা করেছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ এবং চাকরিপ্রার্থীরা।
আলাদা লেনের দাবি
নগরীতে নির্বিঘ্নে সাইকেল চলাচলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আলাদা সাইকেল লেনের দাবি জানিয় আসছেন বিভিন্ন সাইক্লিস্ট গ্রুপ। প্রতি বছর ৭ এপ্রিল বিশ্ব সাইকেল লেনের দিবস উপলক্ষে তারা সাইকেল শোভাযাত্রা এবং সভা-সমাবেশ করে সাইলেকের জন্য আলাদা লেনের দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের এ দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে একাধিকবার আলাদা লেনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক. আবদুল মান্নান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অ্যধাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
সাইকেলের খোঁজ-খবর
ঢাকার সবচেয়ে বড় ও প্রধান সাইকেলের বাজার রাজধানীর বংশালের সাইকেল ব্যবসায়ীরা জানান, সাইকেলের দাম নির্ভর করবে ব্র্যান্ড, ফ্রেম সাইজ, সাইকেলে ব্যবহূত উপাদান এর বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই বয়স অনুযায়ী ফ্রেম সাইজের বিভিন্নতা দেখা যায়। ১০ বছর বা তার নিচে যাদের বয়স তাদের জন্য ১০ ইঞ্চি ফ্রেম, ১০ থেকে ১৫-১৬ বছর বয়সীদের সাধারণত ১৬-২০ ইঞ্চি এবং প্রাপ্তবয়স্কদের এর চেয়ে বড় ফ্রেমের সাইকেলের প্রয়োজন হয়। শেখার জন্য ও চালানোর সুবিধার্থে মাউন্টেন বাইকগুলোই তরুণদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়।
সাইকেলের বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের সাইকেলগুলোর দাম সম্পর্কে তারা জানান, দেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে মেঘনা গ্রুপের স্টিল ফ্রেমের বাইকগুলো পাওয়া যাবে ৭-১১ হাজার টাকার ভেতর, অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের সাইকেলের দাম ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত। মেঘনা গ্রুপের ভ্যালোস, টেলাস, ডায়মন্ডব্যাক, কোর, র্যালি ইত্যাদি দেশি ব্র্যান্ডের সাইকেল বেশ জনপ্রিয় তরুণদের মধ্যে। পাবেন ১৩ থেকে ৩০ হাজার টাকায়।
লায়ন, লায়ন অপটিমাস, গোল্ডেন হুইল প্রভৃতি কোম্পানি সাইকেল আমদানি করে থাকে। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে আপল্যান্ডের দাম ২০-৬০ হাজার টাকা, ট্রেকের দাম ৩০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মতো আর মেরিডার দাম ১৮ থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়াও রকমেশিন, গোস্ট, ফরম্যাট প্রভৃতি বিদেশি ব্র্যান্ডের সাইকেলও বাজারে পাওয়া যায়।
উন্নতমানের ফ্রক, দামি সাসপেনশন, শিফটার, গিয়ার কমবেশি হওয়া, ভালো মানের টায়ার, গতি ও ওজনের ভিন্নতার কারণে সাইকেলের দাম ওঠানামা করে থাকে।
সাইকেলের সঙ্গে এসব দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে সাইকেল সাজানোর নানা সামগ্রীও। ফ্যাশনেবল হেলমেট, বাহারি হ্যান্ড গ্লাভস, স্ট্যান্ড, বেল, ফ্রন্ট লাইট, বটলকেস, মিটার, সুবিধামতো সিট কভার ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কিংবা শখের অনুষঙ্গ পাওয়া যাবে বংশালের অধিকাংশ সাইকেলের দোকানেই।