রোগীর গুরুতর অবস্থায় ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও ইনটেনসিভ কেয়ারে দর্শনার্থী প্রবেশের ব্যাপারে চিকিৎসকদের কঠোর হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত তৃতীয় ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী। এসময় দেওয়া ভাষণে তিনি একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন: আমাদের এটা বড় অসুবিধা হলো ভিজিটরের সমস্যা। কোনো রোগী হাসপাতালে থাকলে ভিজিটর যেতেই হবে। না গেলে রোগীরও মন খারাপ হয়। কিন্তু যে রোগীর খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা, তার কাছেও কেন যেতে হবে?
‘আরেকটা বিষয় আমাদের মতো রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রোগী হলেই তাকে সবার দেখতে যেতে হবে। আর মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর তো যেতেই হবে। না গেলে প্রধানমন্ত্রীরও ইজ্জত থাকে না, রোগী আর রোগীর আত্মীয়-স্বজনেরও ইজ্জত থাকে না।’
এমনকি অপারেশন থিয়েটারেও মানুষ ক্যামেরা নিয়ে ঢুকে পড়ে অভিযোগ করে তিনি বলেন: আমি এখন ক্রিটিক্যাল রোগী দেখতে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। এতে যেকোন সময় রোগীর ক্ষতি হতে পারে। বিদেশে তো যেতে দেয় না।
‘আইসিইউ’তে ঢোকা এখন ভাতমাছের মতো বলে উপহাস করেন প্রধানমন্ত্রী। অভিযোগ করেন, সেখানে রোগীর স্বজন, ভিজিটর সবাই ঢুকে বসে থাকে। আর রাজনৈতিক নেতাও মনে করেন, আমি না গেলে মনে হয় আমার দায়িত্ব ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলাম না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন: এজন্য হাসপাতালে ভিজিটর’স কর্নার করে দেয়া যেতে পারে। সেখানে সবাই বসবেন, খাতায় সই করবেন। এছাড়া এখন ডিজিটাল সিস্টেম করা হয়েছে। এজন্য চাইলে রোগীকে মনিটরে, অথবা কাচ দিয়ে আলাদা করে কাচের অন্য প্রান্ত থেকে দেখা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন, তিনি আগে গুরুতর অবস্থায় থাকা রোগীদের দেখতে গেলেই আইসিইউ’তে ঢুকতে বলা হতো। সাংবাদিকরাও সেই ছবি তুলতে ভেতরে ঢুকে যেতেন। এজন্য এখন ক্রিটিক্যাল রোগী দেখতে গেলে কাচের বাইরে থেকে দেখেন বলে জানান তিনি। আর এজন্য ক্যামেরাম্যানরাও নাখোশ বলে মন্তব্য করেন।
‘তারা তো ছবি নিতে পারছে না। কারণ আমি রোগীর কাছে যাবো, বিছানায় বসবো। তাদের কাছে সেই ছবির অনেক মূল্য। রোগীকে স্পর্শ করতে হবে। কিন্তু তার তো একটা সময় আছে। রোগীর যে বারোটা বাজছে, সেদিকে তাদের খেয়াল থাকে না। তাই ক্রিটিক্যাল কেয়ারের ডাক্তারদের আরও কঠোর হতে হবে। এজন্য দরকারে আমার নাম ভাঙায়েন! আমি বলে যাচ্ছি।’
ডাক্তারের ভালো রোগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায় মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন: এর মধ্য দিয়ে রোগীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। আমাদের চিকিৎসকদের সেভাবেই তৈরি হতে হবে। শুধু ওষুধ খাওয়ালেই মানুষ সুস্থ হয় না।
কোনো ডাক্তার রোগীকে মেরে ফেলতে চান না
রোগীদের মানসিকতার সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন: রোগী একটু অসুস্থ হলেই বলে, আইসিইউ’তে নিলেই ভালো হয়ে যাবে। সব রোগী আইসিইউ’তে নেয়ার মতো না। আবার রোগী মারা গেলে ভাংচুর করে, ডাক্তারকে ধরে পিটায়। এ কেমন কথা? কোনো ডাক্তার তো রোগীকে মেরে ফেলতে চান না। বাঁচাতে চান।
তিনি বলেন: মরণাপন্ন রোগীর চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তাররাও অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। তখন নিজেরাও কতটা ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে রোগীদের চিকিৎসাকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে।
নার্সিংকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে
চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নার্সিংকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন উল্লেখ করে বলেন: আমাদের দেশে সেই কত আগে থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে একটা ছোট বিল্ডিংয়ে ডিপ্লোমা নার্স হিসেবে পড়ালেখার ব্যবস্থা। নার্সিংকে আসলে এতদিন কোনো গুরুত্বই দেয়া হয়নি।
‘‘কিন্তু আমরা নার্সিংকে গুরুত্ব দিয়েছি। এখন পিএসসি’র মাধ্যমে নার্স হতে হয়। এছাড়াও এখন থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে নার্সদের পাঠিয়ে আমরা ট্রেনিং করিয়ে নিয়ে আসছি। আমি যখন ইংল্যান্ডে বা অন্য কোথাও নার্সিং এসোসিয়েশনে যাই, আমি তাদের জিজ্ঞেস করি: তোমরা কীভাবে শেখো, কী করো?
আমরা চাই, নার্সিং যে একটা মর্যাদাপূর্ণ, মানবতার সেবামূলক পেশা, তা আমাদের দেশের মানুষের উপলব্ধি হয়। আমাদের দেশে নার্সিংকে সবসময়ই একটু নীচু চোখে দেখা হতো। কিন্তু আমরা জানি, পুরো পৃথিবীতেই নার্সিং একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা।’’
চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ খুব বেশি দরকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন: ‘আমি যখন সিঙ্গাপুরে গেলাম, সেখানকার চিকিৎসকদের বললাম, আচ্ছা, আপনাদের ম্যাজিকটা কী বলেন তো? রোগী আমাদের ওখানে ডাক্তারের কাছে গেলে বলে ক্রিটিক্যাল, আর আপনাদের এখানে এলে ভালো হয়ে যায়! আপনারা এমন কী করেন?’
তিনি বলেন: চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দেশে পাঠাতে চায় সরকার। ‘ন্য দেশ পারলে আমরা পারব না কেন? আমাদের কি মেধা বা জ্ঞানের অভাব আছে? না।
বেসরকারি মেডিকেল কলেজের প্রতি নজর দেয়ার নির্দেশ
প্রতিটি বিভাগে পর্যায়ক্রমে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এছাড়া বেসরকারি মেডিকেল কলেজের পাঠ্যসূচি, শিক্ষাদান, শিক্ষার মান ও প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরও বেশি নজর দেয়ার কথা বারবার বলেন তিনি। একইসঙ্গে দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসকদের বই লেখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের চিকিৎসকরা সময়োপযোগী বই লিখলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আরও অনেক বেশি তথ্য মেডিকেল শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে। পুরনো পাঠ্যবইয়ের তুলনায় নতুন নতুন রোগ সম্পর্কে সচেতন হবে।