পারিবারিক বাধা আর সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাংলাদেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বিশাল অংশ তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলছে। পোশাক, খাদ্য, মৎস্য, চামড়া, আইটি আর পোলট্রিসহ সব ধরণের কাজেই অবদান রাখতে শুরু করেছে এসব তরুণেরা। তবে তাদের এই পথচলাটা মোটেও সহজ নয়। পদে পদে তাদের বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে। তারপরেও এসব তরুণ উদ্যোক্তারা এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন। বিশ্ব যুব দিবস উপলক্ষ্যে চ্যানেল আই অনলাইনকে দেয়া সাক্ষাতকারে জানিয়েছেন তাদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প। শুনিয়েছেন এ পথের নানা চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কথা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে বিবিএ-এমবিএ করেছেন আশরাফুজ্জামান। সব হোয়াইটকালার জব করে বর্তমানে প্রায় দেড় বছর যাবৎ তিনি নিয়েছেন এক অভিনব উদ্যোগ। বর্তমানে তিনি ফিশ বাংলা নামে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী, যারা চাহিবা মাত্রই বাড়ি বাড়ি নদী ও সমুদ্রের মাছ পৌঁছে দেয়। মাছে ভাতে বাঙালির বিশ্বজোড়া খ্যাতি থাকলেও বর্তমানে চাষের মাছের সহজলভ্যতার কারণে মানুষ ভুলে যেতে বসেছে নদীর মাছের স্বাদ। আর তাই তার এ উদ্যোগে কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষ লাভবান হবে বলে মনে করছেন তিনি। আশরাফুজ্জামানের এ উদ্যোগের পেছনে রয়েছে ছোট্ট একটি গল্প।
আশরফুজ্জামান ও তার দু’সন্তান মাছ খেতে পছন্দ করেন খুব। আর তাই সন্তানদের জন্য ব্রোমিয়াম ও ফরমালিন মুক্ত মাছ সংগ্রহ করতে থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় একবার যান বরিশালের মিঠাপানির মাছের সবচেযে বড় বাজারে। সেখানে গিয়ে মাছের এত বড় বাজার দেখে আর জলজ্যান্ত মাছের সমারোহ দেখে লোভ সামলাতে পারেন না তিনি। কিনে ফেলেন প্রায় ৫০ হাজার টাকার মাছ। বাসায় এনে বন্ধু-বান্ধব সবাইকে বিলাতে থাকেন মাছ। মাছ খেয়ে সবাই প্রভূত প্রশংসা করেন। তাদের প্রশংসা উদ্বুদ্ধ করে আশরাফুজ্জামানকে।
তবে আগে থেকেই একটা ই-কমার্স সাইট খোলার পরিকল্পনা থাকায় দেরি না করে শুরু করেন অনলাইনে মাছ বিক্রি। এ জন্য তিনি দেশের যেসব অঞ্চলে মাছ পাওয়া যায় তার সবগুলোতে ঘুরে সংগ্রহ করতে থাকেন মাছ। দেখতে পান সঠিক পরিবহণ ব্যবস্থার অভাবসহ সঠিক জ্ঞানের অভাবে পথেই নষ্ট হয়ে যায় অধিকাংশ মাছ। আর তাই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিনের গবেষণার পর তার এই সাইটটিকে দাড় করান তিনি।
নদী ও সমুদ্রের মাছ খেতে আগ্রহীদের কাছে তার এ সাইটটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে আশপাশের মানুষের ঠাট্টা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়াটা ছিলো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। ‘বন্ধু-বান্ধবরা প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতো এত ভালো ভালো চাকুরি ছেড়ে দিয়ে মাছওয়ালা হয়ে গেলা?’
তবে এসব কথায় কিছুই মনে করেননা এই তরুণ। ভবিষ্যতে তার এ প্রতিষ্ঠানটিকে আরও বড় করে তোলার লক্ষ্যে অর্গানিক ফুডসহ বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন আইটেম রাখার পরিকল্পনা রয়েছে তার। মূলত বাঙালির প্লেটে ফর্মালিন ও ব্রোমিয়াম মুক্ত বিশুদ্ধ মাছ তুলে দিতে কাজ করেছেন তিনি।
৩ জন নিয়ে যাত্রা শুরু করে মিরপুর ৭ নম্বর রোডের গুটি পা। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত গুটি গুটি পায়ে তা দাঁড়িয়েছে ২০ জনে। মূলত উৎপাদনমুখি কাজের আগ্রহ থেকেই এমন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বলে জানালেন, এর সত্ত্বাধিকারী তাসলিমা মিজি। বাংলাদেশে চামড়া শিল্পটা সহজলভ্য হওয়াতে বেছে নেন চামড়া নির্ভর এক ব্যবসা। চামড়া দিয়ে তৈরী করতে থাকেন ব্যাগ। ফেসবুকে তা পোস্ট করে অনেক সাড়া পান। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একের পর এক তৈরী করে গেছেন বাহারি রং আর ডিজাইনের ব্যাগ। নানা রং আর নকশায় প্রস্তুতকৃত এ ব্যাগগুলো সহজেই আকৃষ্ট করতে থাকে সকলকে।
তবে এ কাজে পরিবার থেকে বাধা না পেলেও খুব একটা উৎসাহ পাননি কখনও। তবে বন্ধুবান্ধবরা তার দুঃসময়ে প্রায়ই বলেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে চাকুরি করার কথা। তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধুরা আমার শুভাকাঙ্খিরা আমার সংগ্রামটা দেখেছে খুব কাছ থেকে। আর তাই যখন তারা ব্যবসায় আমার দুঃসময় দেখে, তখন বলে ব্যবসা ছেড়ে চাকুরি করতে।’ তবে তিনি কোন কিছুতেই পিছপা হন না। অদম্য এ নারী স্বপ্ন দেখেন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তার এই ‘গুটি পা’ ছড়িয়ে যাবে সারা বিশ্বে।
শুরুটা খুৃব বেশিদিন আগের নয় মাত্র চারমাস আগে। এরই মাঝে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তরুণ উদ্যোক্তা মানিকের ছোট্ট কফি শপটি। উত্তরা ৩ নম্বর সেক্টরে গড়ে ওঠা ভিনটেজ কফি এন্ড ক্যাফে শপটি তার ভিন্নতার কারণে দিন দিন হয়ে উঠছে জনপ্রিয়। তবে খুব সহজ ছিলো না এর সত্ত্বাধিকারী মানিকের পক্ষে এমন একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ৮ ভাই-বোনের মধ্যে মানিক সবার ছোট। আর তাই মা-বাবা ও ভাই-বোনদের পরিকল্পনাও তাকে নিয়ে ছিলো একটু ভিন্ন। পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন চাকুরি করলেও কোথাও থিতু হতে পারেননি এ তরুণ।
ভ্রমণণুিপপাসু মানিক বিভিন্ন দেশে ঘুরতে ঘুরতে তৃতীয়বারের মতো যখন মালয়েশিয়াতে যান তখন কুয়ালালামপুরের সেন্দারবি নামে একটি তেল কোম্পানিতে গেলে দেখতে পান, সেখানের হেড অব মার্কেটিং এর যিনি প্রধান তিনি সবাইকে কফি দিয়ে আপ্যায়ন করছেন। বিষয়টা বেশ ভালো লাগে মানিকের। এরপর থেকে ভাবতে থাকেন একটা কফিশপের কথা। যেই ভাবা সেই কাজ।
এরপর থেকে উত্তরায় শুরু করেন ‘ভিনজেন্ট কফি এন্ড ক্যাফে’ নামের একটি রেস্টুরেন্ট। ছোট্ট এ রেস্টুরেন্টে তিনিসহ বর্তমানে কাজ করছেন ৬ জন। তিনি নিজেই মাঝে মাঝে ক্রেতাদের খাবার পরিবেশন করেন।
এ বিষয়ে মানিক বলেন, ‘ আমি বিশ্বের অনেক দেশ ঘুরেছি এবং দেখেছি সেসব জায়গায় কোন কাজকেই ছোট করে দেখা হয় না। আর এ থেকে আমি অণুপ্রাণিত হই।’
তবে এ কাজেও মানিকের চ্যালেঞ্জ ছিলো অনেক। পরিবার থেকে অণুপ্রেরণা পেলেও বন্ধুবান্ধবদের হাসি ঠাট্টার মুখে পড়তে হয়েছে প্রায়শই। ‘বন্ধুরা প্রায়শই বলতো এতো পড়াশোনা করে শেষ পর্যন্ত ভাজার দোকান দিবি?”
তবে কোন কথাই দামিয়ে রাখতে পারেনি মানিকককে। সবার সব কথা উপেক্ষা করে বর্তমানে তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা। স্বপ্ন দেখেন তার ‘ভিনজেন্ট’ নামক কফি শপটি ছড়িয়ে যাবে ঢাকার প্রতিটি প্রান্তে। স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্পন্ন খাবার পরিবেশনই তার প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য।