পুকুর-নদী-খালের দেশ বাংলাদেশে পানিতে ডুবে প্রতিবছর হাজারো শিশু মারা যায়। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের কাছেই শিশুদের এমন মৃত্যু শুধুই ‘আল্লাহর ইচ্ছা’! মানুষের মন থেকে এমন কুসংস্কার দূর করা গেলে হাজারো শিশুর জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ বাংলাদেশ (সিআইপিআরবি) এর একটি গবেষণা থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ১৮ বছরের নিচে মারা যাওয়া শিশুদের মধ্যে বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। ২০০৫ সাল থেকে পরিচালিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী পানিতে ডুবে বছরে অন্তত ১৮ হাজারের মত শিশু মারা যায়।
প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের মনে বদ্ধমূল কুসংস্কার দূর করতে ২০১৬ সাল থেকে ৩০ লাখ ডলারের একটি সমন্বিত প্রকল্প হাতে নিয়েছে সিআইপিআরবি, ব্রিটেন ভিত্তিক রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইন্সটিটিউশন এবং দ্য জর্জ ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ। দেশে প্রথমবারের মতো এটাই ডুবে মারা যাওয়ার হার কমানোর দেশীয়-আন্তর্জাতিক উদ্যোগ।
‘ভাসা’ প্রকল্প নামের এই প্রকল্প শুরুর আগে বরিশালের কীর্তনখোলা এলাকায় জরিপ চালানো হয়। কারণ দেশের দক্ষিণের এই মধ্যাঞ্চলেই ৪-৮ বছর বয়সী শিশুদের ডুবে মরার সংখ্যাটা বেশি। এই এলাকায় জরিপ চালাতে গিয়ে বোঝা যায় সেখানে বেশিরভাগ মানুষই গোটা ব্যাপারটিকে ‘সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা’ হিসেবে ধরে নিয়েছে। সামান্য সচেতনতায় যে শিশুদের ডুবে মরা থেকে বাঁচাতে পারে এমন ধারণা নেই তাদের।
ডুবে মারা যাওয়ার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি গার্ডিয়ানের কাছে তুলে ধরেন সিআইপিআরবি’র সহকারী পরিচালক ড.কামরান উল বাসেত। তিনি বলেন,‘আমরা নানা রোগের টিকা, সংক্রামক ব্যাধি এবং ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা গড়তে পেরেছি। এখন আমাদের সামনে ডুবে মারা যাওয়া ঠেকানোর চ্যালেঞ্জ এসেছে’।
এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন পর্যন্ত খুব কমই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কেবল ২০১৫ সালে স্কুলের শিশুদের সাঁতার শেখানোর জন্য একটি নির্দেশনা জারি করেছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে সে উদ্যোগও সফল হয়নি। অথচ বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ ভূমিই নদ-নদী,খাল-বিলে ভরপুর। আর বরিশালের ক্ষেত্রে একটি প্রবাদ তো আছেই, ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। তাই সাঁতার জানাটা আবশ্যক। অন্তত এদেশের এই অঞ্চলে।
ভাসা প্রকল্পের জরিপে জানা যায়, ৫ বছরের নিচের ডুবে মরা শিশুদের ৪৩ শতাংশের মৃত্যুর কারণ বাড়ির কাছের পুকুর। এমন মৃত্যু ঠেকানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে স্থানীয়দের অযৌক্তিক বিশ্বাস। কারণ তারা ধরেই নিয়েছেন এমন মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব নয়।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন সামাজিক নৃবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ফজলুল কাদের। তিনি জানান, ডুবে মরার ঘটনাকে আল্লাহর ইচ্ছা বা ভগবান চেয়েছেন এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। প্রত্যেক সমাজেই এরকম কুসংস্কার আছে। কেউ কেউ তো পুকুরকেই অভিশপ্ত, খারাপ পুকুর বলেন। একটি সাদা ফুল কিংবা জলপরী ইশারায় শিশুদের ডেকে পানিতে নামায় বলেও অনেকের বিশ্বাস।
এমন এলাকায় ডুবতে বসা শিশুদের উদ্ধার করা গেলেও প্রাচীন পদ্ধতির চিকিৎসায় অনেকেই প্রাণ হারায়। আসলে পুরো বিষয়টাতেই সচেতনতার অভাব স্পষ্ট। শিশুদের ডুবে যাওয়ার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে। কারণ এই সময়ে কাজে ব্যস্ত মা-বাবা কিংবা পরিবারের চোখের আড়ালে থেকে যায় অধিকাংশ শিশু। তাই এ ব্যাপারে সচেতনতা গড়ে শিশুদের ডুবে মরার হার কমাতে ভাসা প্রকল্প বাস্তবমুখী কাজের আশা জাগাচ্ছে।