নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে এ বছর অপেক্ষার প্রহর ছিল। সেই সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবার সম্মানজনক এই পুরস্কার পেয়েছেন নাদিয়া মুরাদ এবং ডেনিস মুকওয়েগা। যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধে কাজ করায় তারা যৌথভাবে এই পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল কমিটির বক্তব্য, যুদ্ধাপরাধের বিরোধিতা করতে গিয়ে এবং আক্রান্তদের ন্যায়বিচার চাইতে গিয়ে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছেন।
রিপাবলিক অব কঙ্গোর ডাক্তার ডেনিস মুকওয়েগা যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা বন্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করে গেছেন। আর ইরাকের ইয়াজিদি নৃগোষ্ঠির নাদিয়া মুরাদ আইএসের দ্বারা আটক হন এবং বারবার ধর্ষিত হন তাদের হাতে। কিন্তু পরবর্তীকালে তার অসাধারণ সাহস তার নিজের কষ্টকে বর্ণনা করার সাহস যুগিয়েছে।
যৌন সহিংসতাকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যে কতোটা অমানবিক তা আমরা বুঝি। কারণ, ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানিদের হাতে আমরাও এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। আমাদের লাখ লাখ মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। বিষয়টি এমনই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যা স্মরণ করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। এমনকি সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৭ দিনের মাথায় প্রসূতি মায়ের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা। সেই সব মা-বোনরা এখনও ৭১ এর দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।
যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা বন্ধের চেষ্টাকারী নাদিয়া এবং ডেনিসকে পুরস্কার দিয়ে ৭১ এর বীরাঙ্গনাদের সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা নতুন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিল নোবেল কমিটি। এত বড় ঘটনার পরও আজ পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি খুনি এবং ধর্ষক রাষ্ট্র পাকিস্তান। আমরা মনে করি, এবারের নোবেল পুরস্কারের ধারাবাহিকতায়, মুক্তিযুদ্ধে খুন, ধর্ষণ এবং অমানবিক অন্যান্য নির্যাতনের বিষয়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানের টুটি চেপে ধরার পথ বাংলাদেশের জন্য আরও সুগম হলো। বিষয়টি এখন নতুন করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।
এর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। যদিও বেশ কয়েকজন বীরাঙ্গনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তবে এখনও লাখ লাখ মা-বোন স্বীকৃতি পাননি। একাত্তরে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাদের অনেকেই হয়তো মারা গেছেন। এখন যারা জীবিত আছেন তাদের অনেকে বয়সের ভারে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই সময়ে তারা যদি রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান এবং ধর্ষকদের আন্তর্জাতিকভাবে ধিক্কার পেতে দেখেন তাহলে তারা অন্তত মৃত্যুর আগে শান্তি পাবেন, যা অনেক আগেই তাদের প্রাপ্য ছিল। বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া যেহেতু কোনোভাবেই আমাদের সম্ভব নয়, তাই তাদের জন্য এইটুকু করতে আমরা সংশ্লিষ্টদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। যুদ্ধকালীন যৌন সহিংসতা বন্ধে নিরলসভাবে কাজ করে যাওয়ায় নাদিয়া মুরাদ এবং ডেনিস মুকওয়েগাকে অভিনন্দন।