বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত হুমায়ুন কবীরের সম্প্রতি দিল্লি সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তো বটেই, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানারকম আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।
যদিও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন যে, এটি কোনো রাজনৈতিক সফর ছিল না। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রেণও ভারতে যাননি। বরং গিয়েছিলেন কয়েকটি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে; যেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
একটি দেশের রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা আরেকটি দেশের থিংক ট্যাংক অথবা রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রণে সে দেশে যেতেই পারেন। বিএনপির এই প্রতিনিধি দলের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও একটি বড় প্রতিনিধি দল ভারতে গিয়েছিলেন সে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে। তাহলে কেন বিএনপির এই সফর নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে? কারণ একটাই, তা হলো এটি নির্বাচনের বছর এবং বিএনপি ‘ভারতবিরোধী’ দল বলে পরিচিত। আর এরকম একটি ধারণা বা মতামতও দেশের রাজনীতিতে প্রচলিত আছে যে, ভারতের কাছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ‘পছন্দের’ দল।
কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন যে, বিএনপি কি ভারতের কাছে গিয়ে তাদের অনুকম্পা চাইছে এবং নিজেদের শরীর থেকে ভারতবিরোধী গন্ধ দূর করতে চাইছে যাতে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে আওয়ামী লীগের উপর ভারত চাপ সৃষ্টি করে? বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তারা বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের জন্য ভারতের সহায়তা চান। তারা মনে করেন, বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের ওপর ভারতের যথেষ্ট প্রভাব আছে। সেই প্রভাব ভারত কাজে লাগাতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ চাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে প্রধান দুই দলের মধ্যে কে কত ভারতবিরোধী অথবা ভারতপন্থি তা প্রমাণের একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
২০১৫ সালের ২ জুন একটি জাতীয় দৈনিকের (কালের কণ্ঠ) শিরোনাম ছিল, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পেলে বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ভারতের হস্তক্ষেপ চাইবে বিএনপি।’
সম্প্রতি বিএনপির প্রতিনিধি দলের এই ভারত সফর নিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং ভারতীয় গণমাধ্যমও সরব। লেখক-সাংবাদিক এস এন এম আবদী লিখেছেন, ‘এই মূহুর্তে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। এটা ভারতীয় নীতির এক নম্বর প্রায়োরিটি।’ এই ভারতীয় সাংবাদিকের কথায় এটি কি পরিস্কার হয় যে, ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখে এবং প্রভাব বিস্তার করে?
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধিতা একটি সাধারণ ইস্যুতে পরিণত হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পরে এই মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হয়। নিজের ক্ষমতা সংহত করা এবং জনপ্রিয়তা অর্জনে তিনি ভারতবিরোধী শিবিরের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মৌলবাদী ও চীনপন্থি বামপন্থি দলগুলোকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সরকারি আনুকূল্য দেয়া হয়। পাকিস্তানি ভাবধারায় সংবিধানও সংশোধন করা হয়। এসব কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দানকারী বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাংলাদেশের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তবে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে ভারতের সঙ্গে এই ব্যবধান কমে আসতে থাকে। কিন্তু ওই সময়ে আওয়ামী লীগের জন্য এট একটি বড় চ্যালেঞ্জও ছিল। কেননা বছরের পর বছর ধরে এখানে ভারতবিরোধিতা সাধারণ মানুষের মনেও এরকম পোক্ত করে দেয়া হয়েছিল যে, তখন ‘রুশ ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’ কিংবা ‘চশমা পরা বুবুজান, নৌকা লইয়া ভারত যান’––এরকম শ্লোগানও দেয়া হয়েছে।
ইতিহাস বলছে, সদ্য স্বাধীন দেশে জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে বঙ্গবন্ধুর ধারেকাছেও কেউ ছিলেন না। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার অনেক ইস্যুতেই বিরোধীদের আপত্তি ছিল। একদিকে তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে বঙ্গবন্ধুর নীতির বিরোধিতা করা বা তাঁর বিরুদ্ধে জনমতকে প্রভাবিত করা সহজ ছিল না, আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ হওয়ায় তখন সমস্যারও অন্ত ছিল না। আওয়ামী লীগের ভেতরেই নানা কোন্দল ছিল। এসবের সুযোগ নিয়ে বিরোধিরা ভারতবিরোধিতার অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে। অর্থাৎ তারা দেশের যেকোনো সমস্যার জন্য ভারতকে দায়ী করতে থাকে এবং বঙ্গবন্ধু সরকারকে ‘ভারতের দালাল’ বলে আখ্যা দিতে থাকে।
প্রশ্ন হলো আমাদের রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারত কেন ফ্যাক্টর বা গুরুত্বপূর্ণ? আমাদের রাজনীতিকরা নিয়ে নিজেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিতে অপারগ? তারা কেন অন্য দেশের হস্তক্ষেপ চান? কেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘ দূতকে আসতে হয়? কেন জন কেরিকে ফোন করতে হয়? কেন ভারতের নীতিনির্ধারকদের বাংলাদেশে এসে সবক দিতে হয় বা কেন তাদের কাছ থেকে পরামর্শ ধার করতে হয়? ভারতের রাজনীতিতে বা নির্বাচনে কি বাংলাদেশের রাজনীতিকরা গিয়ে নাক গলান বা সেই মুরোদ তাদের আছে? আমাদের রাজনীতিকরা কি এটি বোঝেন না যে, আমার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা নির্বাচনে অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ বা দুতিয়ালি সামগ্রিকভাবে আমাদের জনগণকেই খাটো করে? এটি কি আখেরে আমাদের রাজনীতিবিদদের দীনতাই প্রকাশ করে না?
‘ভারতের কাছে মুচলেকা দিয়ে অমুক দল ক্ষমতায় এসেছে’ বা ‘ভারতের শর্তে রাজি হইনি বলে আমরা অমুক সালে নির্বাচনে হেরে গেছি’– এইসব কথাবার্তার মাধ্যমে রাজনীতিকরা জনগণের সামনে কী তুলে ধরেন? মানুষ যে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভোট দেয়, শত শত কোটি টাকা গণঅর্থ খরচ করা হয়, সেগুলো কি সব বোগাস? যদি ভারতের কাছে মুচলেকা দিলেই ক্ষমতায় আসা যায়, তাহলে ভোটের দরকার কী? বস্তুত এই মুচলেকা দেয়া বা ভারতের সাথে দেশবিরোধী চুক্তি করা না করার কথা বলে রাজনীতিকরা নিজেদেরকেই ছোট করেন। সেইসঙ্গে ছোট করেন নিজের দেশ ও জনগণকে।
একটি দেশ কী করে আরেকটি দেশের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করে বা ভোটের ফলাফল নির্ধারণ করে? ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি। ট্রাম্পের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিনের সঙ্গে রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তদন্ত করছে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কি মনে করে যে, ভারতের কাছ থেকে তারা এরকম কোনো গোয়েন্দা সহায়তা পাবে?
একটি দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আরেকটি দেশের নির্বাচনে চূড়ান্ত বিচারে কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারে? তারা কি ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ব্যালট পেপারে সিল দেবে নাকি ভোটের ফলাফল উল্টে দেবে? নাকি ভোটের আগের রাতে সব ব্যালট বাক্স ভরে ফেলবে? নাকি ভোটের মেকানিজমে তারা প্রভাব বিস্তার করবে? এগুলো কি আদৌ সম্ভব? যদি তাই হয়, তাহলে কি নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান রাখার কোনো প্রয়োজন আছে? আর যদি এসব সম্ভব না হয়, তাহলে ভারতের কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসা কী অর্থ বহন করে?
নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে বিদেশি শক্তির সহায়তা নেয়া বা পছন্দের দলকে প্রভাবশালী কোনো রাষ্ট্রের সমর্থন নতুন কিছু নয়। বিশ্বের অনেক দেশেই এর নজির আছে। শক্তিশালী কোনো দেশ যদি মনে করে বিশেষ কোনো দল ক্ষমতায় গেলে তার সুবিধা বা তার পার্পাস সার্ভ করবে, তাহলে সে ওই দলকে সমর্থন দিতেই পারে। কিন্তু সেই সমর্থন বা সহায়তার মাত্রা কতটুকু? তারা কি একটি ভোটের ফলাফল উল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখে?
ভারত একটি বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। তারা তার সবচেয়ে নিকটতম এবং বিশ্বস্ত প্রতিবেশী ও বন্ধুরাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়নে সহায়তা করতেই পারে। একশো কোটি লোকের একটি দেশ কীভাবে দশকের পর দশক ধরে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে এবং কীভাবে সেদেশের নির্বাচন কমিশন সরকারের প্রভাব ও চাপমুক্ত থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে, ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা নিতেই পারে? কিন্তু আমরা এই অভিজ্ঞতা কি কখনও নিয়েছি? বলা হয়, ভারতের রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের তুলনায় অনেক বেশি দেশপ্রেমিক। কেন আমাদের এই অপবাদ শুনতে হয়? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পেছনে রয়েছে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত।
রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বেই এদেশের সেনাবাহিনী, কৃষক, মজুর, শিক্ষক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মুক্তির সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সেই দেশের রাজনীতিবিদদের দেশপ্রেম নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে? একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজনীতিকরা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে কেন অন্য দেশের উপর নির্ভর করবেন? এটি কখনোই কাম্য বা কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।
সুতরাং বিএনপির সাম্প্রতিক এই ভারত সফর নিয়ে যত বিশ্লেষণই হোক না কেন, সারকথা হলো, রাজনীতি ও নির্বাচনে ভারতনির্ভরতা বা ভারতবিরোধিতা––এর কোনোটিই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক নয়। এই বাস্তবতাটি আমাদের রাজনীতিবিদরা যত দ্রুত বুঝবেন, দেশকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর তত সহজ হবে। অন্যের পায়ে ভর করে বেশি দূর যাওয়া যায় না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)