ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর পদে থাকা নিয়ে রুল নিষ্পত্তির জন্য গঠিত হাইকোর্টের একক বেঞ্চ শুনানিতে বিব্রতবোধ করেছেন।
এর আগে কয়েকটি একক বেঞ্চ ঘুরে মামলাটি বিচারপতি ফরিদ আহমেদের একক বেঞ্চে সোমবার শুনানির জন্য উঠলে এই বেঞ্চও বিব্রতবোধ করে মামলার নথি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর আদেশ দেন।
এখন প্রধান বিচারপতি এ মামলার নিষ্পত্তির জন্য নতুন একক বেঞ্চ নির্ধারণ করবেন বলে জানিয়েছেন রিট আবেদনকারীর আইনজীবী সত্য রঞ্জন মণ্ডল।
২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর নিজাম হাজারীর পদে থাকার বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলে বিভক্ত রায় দেয় বিচারপতি মো. এমদাদুল হক ও বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসানের হাই কোর্ট বেঞ্চ।
জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. এমদাদুল হক রুল মঞ্জুর করে নিজাম হাজারীর পদে থাকাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। আর কনিষ্ঠ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান রিট ও রুল খারিজ করে দেন। অর্থাৎ তার রায়ে নিজাম হাজারীর এমপি পদ বৈধ।
এরপর আইন অনুসারে রিট আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে গেলে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য তিনি একক বেঞ্চ গঠন করে দেন। পরবর্তীতে কয়েকটি একক বেঞ্চ ঘুরে মামলাটি বিচারপতি ফরিদ আহমেদের কাছে পাঠানো হয়।
সত্যরঞ্জন মন্ডল বলেন, সোমবার আদালত এ মামলার শুনানি নিতে বিব্রতবোধ করেন। এ মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে এর আগেও কয়েবার আদালত বিব্রতবোধ করেছেন।
‘সাজা কম খেটেই বেরিয়ে যান সাংসদ’ শিরোনামে ২০১৪ সালের ১০ মে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে তার ওই পদে থাকার বৈধতা নিয়ে ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া রিট আবেদনটি করেন।
এ মামলায় নিজাম হাজারীর পক্ষে শুনানি করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম সুজন এমপি। রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী ও সত্যরঞ্জন মন্ডল। রাষ্ট্রপক্ষে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুর রহমান চৌধুরী।
রিট আবেদনকারীর যুক্তি, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না।
২০০০ সালের ১৬ অগাস্ট অস্ত্র আইনের এক মামলায় দুটি ধারায় ১০ বছর ও সাত বছর কারাদণ্ড হয় নিজাম হাজারীর, যা আপিলেও বহাল থাকে। সেই হিসেবে নিজাম হাজারী ২০১৫ সালের আগে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য না হলেও তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হয়ে যান বলে অভিযোগ করা হয় রিট আবেদনে।
প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালের ৮ জুন বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে রুল জারি করে।
নিজাম হাজারী কোন কর্তৃত্ববলে ওই আসনে সংসদ সদস্য পদে আছেন এবং ওই আসনটি কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে৷ পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনাও দেয় আদালত।
ওই রুলের উপর শুনানি গ্রহণে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের এক বিচারপতি এবং পরে ২ ডিসেম্বর অন্য একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিব্রতবোধ করে।
প্রধান বিচারপতি এরপর বিষয়টি শুনানির জন্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হকের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে পাঠান। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি হাই কোর্টে রুলের উপর শুনানি শুরু হয়।
শুনানিকালে ৩০ মার্চ হাই কোর্ট নিজাম হাজারীর কারাবাসের সময় ও রেয়াতের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। সেইসঙ্গে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে করা মামলার রায় ও নথিপত্র ৩০ দিনের মধ্যে দাখিল করতে বলে।
এরপর ওই বছরের ২৬ মে অন্য এক আদেশে হাই কোর্ট অস্ত্র মামলায় নিজাম হাজারীর কারাবাসের সময় ও রেয়াতের বিষয় তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে কারা মহাপরিদর্শককে (আইজি-প্রিজন্স) নির্দেশ দেয়।
এ নির্দেশনা অনুসারে আইজি-প্রিজন্সের দেওয়া প্রতিবেদন ১৯ জুলাই আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সেখানে বলা হয়, ১০ বছরের সাজার মধ্যে নিজাম হাজারী সাজা খেটেছেন ৫ বছর ৮ মাস ১৯ দিন। কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাজা রেয়াত পেয়েছেন ১ বছর ৮ মাস ২৫ (৬২৫ দিন)। রেয়াতসহ মোট সাজা ভোগ করেছেন ৭ বছর ৫ মাস ১৪ দিন। এখনও সাজা খাটা বাকি আছে ২ বছর ৬ মাস ১৬ দিন।
এরপর ২০১৬ সালের ৩ অগাস্ট এই রিটের রুলের ওপর শুনানি শেষ করে আদালত ১৭ অগাস্ট রায়ের দিন ঠিক করে দিলেও ওইদিন নতুন একটি নথি চাওয়া হলে রায়ের তারিখ পিছিয়ে যায় ২৩ অগাস্ট।
কিন্তু ২৩ অগাস্ট আদালতে ফের শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবীরা। ‘রক্তদান করে’ নিজাম হাজারী কারাবাস রেয়াতের অধিকারী হয়েছেন বলে তার আইনজীবীরা সেদিন আদালতে যুক্তি দেন।
শুনানির পর আদালত ৩০ অগাস্ট রায় দেওয়া শুরু করলেও নিজাম হাজারীর আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন সেদিন বলেন, নিজাম হাজারী কারাগারে থাকার সময় মোট ১৩ বার রক্ত দিয়েছিলেন। যার বিপরীতে তিনি ৪৮৬ দিনের কারাবাস থেকে রেয়াত পাওয়ার অধিকারী হয়েছেন। এটা ধরা হলে তার সাজার মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় তিনি কারাগারে ছিলেন।
তাদের ওই যুক্তির পর ৩১ অগাস্ট আদালত নতুন প্রতিবেদন চায়। নিজাম হাজারী কারাবাসকালে কত ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন, এর ফলে কতদিন কারাবাস রেয়াত পাওয়ার অধিকারী হয়েছেন, ৩০ দিনের মধ্যে তা প্রতিবেদন আকারে দিতে বলা হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।
৩ নভেম্বর আবার এ বিষয়ে শুনানি শুরু হলে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, নিজাম হাজারীর রক্তদানের বিষয়ে কোনো নথি তাদের কাছে নেই।
এরপর আরও কয়েক দফা রায়ের তারিখ পেছনোর পর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করে হাই কোর্ট।
কিন্তু বিভক্ত রয়ের কারণে আইন অনুসারে রিট আবেদনটি প্রধান বিচারপতির কাছে গেলে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য তিনি একক বেঞ্চ গঠন করে দেন। পরবর্তীতে কয়েকটি একক বেঞ্চ ঘুরে মামলাটি বিচারপতি ফরিদ আহমেদের কাছে আসলে সোমবার এই বিচারপতিও বিব্রতবোধ করে আদেশ দেয়।