‘যুক্তরাষ্ট্রের সমগ্র ভূখণ্ড এখন নর্থ কোরিয়ার মিসাইলের আওতাভুক্ত’ সম্প্রতি এমন এক ঘোষণা দিয়ে চলমান `নর্থ কোরিয়া-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে’র আগুনে ঘি ঢেলেছে নর্থ কোরিয়া। গত ৯ আগস্ট বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গুয়াম অঞ্চলের বিমানঘাঁটিতে মিসাইল হামলা করার হুমকি দিয়ে ‘ট্রাম্প’ কে মুখ খুলতে বাধ্য করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট কিম জং উন।
ট্রাম্পের বক্তব্য ও অবস্থান দেখে অনেকেই মনে করেন নর্থ কোরিয়ার সম্প্রতি সময়ের এই আস্ফালনের জন্য হয়তো তিনিই দায়ী। আসলে বিষয়টির সঙ্গে অতীতের প্রেসিডেন্টরাও কমবেশি দায়ী। এ বিষয়টিই জেনে নেয়া যাক।
নর্থ কোরিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন ‘হুমকি’ মূলক বক্তব্য এই প্রথম নয়। নর্থ কোরিয়াকে চাপে রাখতে ট্রাম্পের উত্তরসূরী বারাক ওবামা, জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং বিন ক্লিনটনও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। পরপর তিনজন প্রেসিডেন্টের নানা কূটনৈতিক তৎপরতা ও হুমকি-ধামকিতে নর্থ কোরিয়া ইস্যুর কোন সমাধান হয়নি। বরংচ সময়ের ব্যবধানে নর্থ কোরিয়ার আগ্রাসী আচরণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতি নিউজউইককে দেয়া এক সাক্ষাতকারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তণ নাভাল ইন্টেলিজেন্স অফিসার এবং ফরধাম ইউনিভার্সির ইন্টারন্যাশনাল ল বিভাগের অধ্যাপক থমাস এইচ. লি বলেছেন, নর্থ কোরিয়া নিয়ে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনের নীতির আশু কোন পরিবর্তন হবে না। প্রাক্তন প্রশাসনের থেকে কার্যক্রমের ভিন্নতা থাকলেও বর্তমান প্রশাসনের অবস্থানও অতীতের একটি মতো একটি জায়গায় গিয়ে শেষ হবে।
‘সুদে-আসলে জবাব দেয়া হবে’, ‘সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এসব শব্দ চয়নের পেছনে স্টেট সেক্রেটারি রেক্স টিলারসন এবং প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি জেমস ম্যাটিসের প্রভাব রয়েছে। কোন হুমকিকে আমলে নিয়ে আমেরিকার নাগরিকদের রাতের ঘুম নষ্ট না করলেও চলবে। কারণ পৃথিবীর যে কোন শত্রুকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রাক্তণ এই অফিসার।
বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালে নর্থ কোরিয়ার নিউক্লিয়ার পরীক্ষা ও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ঘটনায় দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন তিনি। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে আমেরিকায় থাকা নর্থ কোরিয়ার সব সম্পত্তি জব্দ করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন তিনি। এসময় অবশ্য আমেরিকাতে নর্থ কোরিয়ার যে কোনো ধরণের রপ্তানি ও বিনিয়োগ করাও নিষিদ্ধ ছিলো।
নর্থ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে যে কোনো ব্যক্তি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে কাল তালিকাভুক্ত করার ক্ষমতা ছিল মার্কিন সরকারের।এতরকম সিদ্ধান্ত নিয়েও যুদ্ধকে এড়িয়ে চলেছিলেন তিনি। তারপরও সমস্যার সমাধান হয়নি।
একইরকম ঘটনা ঘটেছে জর্জ ডব্লিউ বুশ কিংবা বিন ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়েও। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি।
২০০৩ সালের জানুয়ারিতে পারমাণবিক বিস্তাররোধ চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় নর্থ কোরিয়া। এসময় ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটোমিক এনার্জি এজেন্সির পরিদর্শকদেরকেও অপমান-অপদস্থ করে বের করে দেয়া হয়।
বুশ প্রশাসনের সঙ্গে জাপান, সাউথ কোরিয়া, চীন ও রাশিয়া ঘটনাচক্রে সিক্স-পার্টি আলোচনা শুরু করতে নর্থ কোরিয়াকে রাজি করে। এই প্রস্তাবে সম্মত হলে নর্থকোরিয়ার ৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন জ্বালালি তেল বা সমপরিমাণ অর্থনৈতিক সহায়তার সুযোগ দেয়া হয়। এর মধ্যে বুশের ক্ষমতা শেষ হবে হবে এমন অবস্থা। বুশ তৎকালীন নর্থ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জন ইলকে ব্যক্তিগত একটি পত্রও লিখেছিলেন যাতে বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও ২০০৯ সালে রকেট পরীক্ষা করে এবং ওই শান্তি আলোচনা সেখানেই থমকে থাকে।
বুশের মতো ক্লিনটনও নর্থ কোরিয়াকে প্রায় বশে নিয়ে এসেছিলেন ১৯৯৪ সালে। ওই বছরের অক্টোবর মাসে কিম জন সাং ইলের মৃত্যুর তিন মাস পর, তখনও কিম জন ইল আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি, সে সময়ে ক্লিনটন সাউথ কোরিয়া, জাপান, রাশিয়া, জার্মানিকে সঙ্গে নিয়ে নর্থ কোরিয়ার চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি সম্পাদক করতে চেয়েছিলেন। যার মাধ্যমে লাইট ওয়াটার নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর তৈরি করার কথা ছিল, যার বর্জ্যকে বোমায় রূপান্তর করা ছিল প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু এর এক সপ্তাহ পরেই রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় আসে এবং নর্থ কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার সেই সুযোগটিও ভেস্তে যায়। নতুন ক্ষমতায় আসা বুশের পক্ষে নর্থ কোরিয়া নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা অনেক কঠিন ছিল। যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে। নর্থ কোরিয়া ইস্যুতে ট্রাম্পকে এককভাবে ব্যর্থতার দায় দেয়া যায় না।