প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে মহাসমারোহে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় প্রাণের বইমেলা শুরু হয়। পাঠক, প্রকাশক, লেখক এবং সার্বিক দিক বিবেচনায় বইমেলার বিস্তৃতি ও পরিধি বিগত সময়ের তুলনায় সগৌরবে বিস্তার লাভ করছে।
মেলার পরিধি বৃদ্ধি পেয়ে বাংলা একাডেমি চত্ত্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও স্টলের জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি স্বাভাবিক দৃষ্টিতে ইতিবাচক বলেই মনে হচ্ছে। কেননা বইয়ের সংখ্যা যেমনভাবে বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেখকের সংখ্যা, পাঠকের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কিন্তু প্রকৃত পাঠক বলতে যাদের বোঝায় তাদের সংখ্যা নেহায়তই কম। বই পড়ার জন্য ক’জন পাঠক বই ক্রয় করে সেটা বিবেচ্য বিষয়। পরিচিতজন, প্রিয়জনের অটোগ্রাফ সংগ্রহ করার জন্য অনেকেই ইচ্ছায়/অনিচ্ছায় বই ক্রয় করে থাকে।
এখন অনেকেই বলতে পারেন তাহলে যে বিপুল পরিমাণে বই বিক্রয় হচ্ছে সেগুলো কি সঠিকভাবে পড়া হচ্ছে না। আমি তো হলফ করে বলতে পারি, অবশ্যই পড়া হচ্ছে না। অনেকেই বাসায় সাজিয়ে রাখার জন্য কিংবা অনুরোধে ঢেঁকি গিলে বই ক্রয় করে থাকে অথবা লেখক যদি প্রভাবশালী কেউ হোন তার কৃপা কিংবা সখ্য বৃদ্ধির জন্য বই সংগ্রহ করে অন্যদের সরবরাহ করে থাকে। যদি সঠিকভাবে পড়া হতো তথা বইয়ের অনুশীলন করা হতো তাহলে প্রকৃত পাঠক পেতাম আমরা। প্রকৃত পাঠকরা লেখককে দেখে কখনো বই ক্রয় করেন না, বই কিনেন বইয়ের বিষয়বস্তু ও লেখার গুণগত মান দেখে। কিন্তু ইদানিং কালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বইয়ের বিষয়বস্তু না জেনেই শুধুমাত্র লেখকের পরিচয় জেনেই পাঠকমাত্রই বই ক্রয় করে থাকেন। আরে সেসব পাঠকের সংখ্যাই বেশি হওয়ায় প্রকৃত পাঠক তৈরি হচ্ছে না।
তবে জোরের সঙ্গে বলা যায়, প্রকৃত পাঠক তৈরি হলে প্রকৃত লেখকও বের হয়ে আসতো বর্তমান সময়ে। কেন আমাদের মধ্য থেকে প্রথিতযশা লেখক বের হয়ে আসছে না সে প্রশ্নের উত্তর সহজে আমরা খুঁজতে যাই না। তবে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে সমাধান বের করে নিয়ে আসতে পারলে বাংলা সংস্কৃতির জন্য অবশ্যই বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা কিন্তু একজন কাজী নজরুল ইসলামকে বের করে নিয়ে আসতে পারছি না। আবার অনেকেই দ্বিমত করতে পারেন, কাজী নজরুল সভ্যতায় একবারই আসে যাদেরকে সৃষ্টিকর্তা বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কেননা কাজী নজরুল ইসলাম মুখ দিয়ে যা বের করতেন তাই কোন না কোন গান ও গজলে পরিণত হতো। কিংবা হাত দিয়ে যা লেখতেন তাই কবিতা বা অন্যান্য সৃষ্টিতে পরিণত হতো। সেক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ব্যতিক্রম এবং এ কারণেই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃত।
আচ্ছা কাজী নজরুল ইসলামের উদাহরণ বাদই দিলাই, জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ কিংবা অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর মতো জীবনমুখী উপন্যাসও কিন্তু তেমন দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ লেখক হওয়ার জন্য যে অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সাধনার প্রয়োজন রয়েছে বর্তমানকালের ক’জন লেখক সে কাজটি সুচারূরুপে সম্পন্ন করতে পেরেছে। জাস্ট লেখার জন্য লেখা এমন লেখকের সংখ্যাই সমসাময়িককালে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে ভাল মানের লেখা যে হচ্ছে না সেটি কিন্তু নয়, তবে সে সংখ্যা খুবই কম। হয়তোবা আজ থেকে ১৫-২০ বছর পরে বর্তমান সময়ের লেখকদের অনেক লেখাই পাঠকের নিকট বিশেষভাবে সমাদৃত হবে। তবে এমন লেখক এবং লেখার সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। তবে একটা কথা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যারা হারিয়ে যাচ্ছে তাদের মতো তেমন কাউকে আমরা তৈরি করতে পারছি না। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান কিংবা হালের সব্যসাচী লেখক (প্রয়াত) সৈয়দ শামসুল হক কিংবা হুমায়ুন আহমেদ আমাদের মধ্যে আসছে না। যে বিষয়টি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে একটি মারত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে।
নতুন লেখক আমরা কেন তৈরি করতে পারছি না কিংবা কেন বের হয়ে আসছে না সে বিষয়ে আমাদের অবশ্যই বিশদভাবে আলোচনা করা উচিত। বেশ কিছু কারণকে ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি।
প্রথমত, লেখার জন্য একজন লেখককে যে বিস্তর জ্ঞান আহরণ করা প্রয়োজন বর্তমান কালের অনেকেই সে বিষয়টি পরিহার করে নিজে লেখার দিকে মনোযোগ দেন। স্বাভাবিকভাবে আমরা জানি পড়াতে হলে পড়তে হয় সে দিক বিবেচনায় লিখতে হলে আপনাকে জ্ঞানের রাজ্যে বসবাস করতে হবে। জ্ঞানের রাজ্যে না থেকে নতুন লেখকদের মধ্যে অনেকেই তাদের মতো করেই লিখতে বসে বিধায় লেখাগুলো সেভাবে পাঠকপ্রিয়তা পায় না।
দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিকভাবে লেখার সব কৌশল রপ্ত করেই অনেকেই লেখালেখির জগতে পা রাখেন আবার কেউ কেউ লিখতে লিখতে পরিপক্ক লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। যারা একেবারে নতুন লেখক তাদেরকে সাহিত্য জগতে সকলের যেভাবে আমন্ত্রণ কিংবা সাধুবাদ জানানো উচিত আমরা সেভাবে আমন্ত্রণ জানানোর রীতি অবলম্বন করতে পারছি না। নতুনদের লেখায় তথ্যগত সামান্য ভুল পরিলক্ষিত হলেও শুধরানোর সুযোগ না দিয়ে চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করার মিশনে নামে একদল লোক যার কারণে তরুণরা সাহিত্য জগত থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যারা লিখেন তাদেরই ভুল হবার সম্ভাবনা রয়েছে আর যারা লেখার জগতের মানুষ নন তাদের তো ভুল হবে না কখনো কেননা তারা কখনো বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার সৎসাহস দেখাতে পারেন না।
তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা নিজেদেরকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিগণিত করে থাকেন এবং বিশেষ করে তারাই নতুনদের লেখার সমালোচনা করে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার কাজটি অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে চতুরতার সহিত সম্পন্ন করে থাকে। অথচ তাদের নিজেদের কোন প্রতিষ্ঠিত লেখা নেই কিংবা একক কোন বই এখনো প্রকাশ করার সাহস দেখাতে পারেনি কিংবা মোটামুটি ছাপার মতো পান্ডুলিপি তাদের হাতে নেই তদুপরি তারা অন্যের সমালোচনা করতে পটু। এসব মানুষ সাহিত্য জগতের তথা পুরো সমাজের শত্রু। তারা নিজেরা যা ভাল মনে করে সেটাকে সত্য এবং প্রতিষ্ঠিত হিসেবে ধরে নিতে সামান্য দ্বিধা করেন না। অথচ তারা কিন্তু পুরোটাই ঘোরের মধ্যে ডুবে আছেন। এ জাতীয় নামস্বর্বস্ব বুদ্ধিজীবীদের করাল গ্রাস হতে সাহিত্য জগতে নতুন করে অন্তর্ভুক্তিদের রক্ষার জন্য সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।
চতুর্থত, লেখক সৃষ্টির জন্য সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন রয়েছে, অনেক সময় দেখা যায় নতুনদের অনেকেই বিভিন্ন কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। তাদেরকে ঝরে পড়া থেকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, সমৃদ্ধি এবং স্মৃতি টিকিয়ে রাখা এবং ধারাবাহিকতার রক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে।
বইয়ের মানের ক্ষেত্রে লেখক-প্রকাশকদের আরেকটু সচেতন হওয়া জরুরী। নতুন লেখকদের অনেকেই প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই বের করে থাকে, যেটি সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। প্রকাশকদেরও উচিত হবে মানসম্মত বই বাজারে নিয়ে আসা। পান্ডুলিপি জমা দিলে অধিক যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে বই যেন পাঠউপযোগী হয় সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বই প্রকাশ করা। বছরে অধিক সংখ্যক বই প্রকাশ করলেই প্রকাশককে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দেওয়া ঠিক হবে না। শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা প্রদান করতে হবে বইয়ের মান এবং পাঠকের নিকট গ্রহণযোগ্যতা দেখে। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কর্তৃক প্রকাশকদের পুরস্কারের সংবাদ পত্রিকার পাতায় দেখা যায়, কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তাদেরকে সম্মানিত করা হচ্ছে সে বিষয়ে খুব বিশদভাবে জানার সুযোগ হয়ে উঠে না। যাই হোক আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি প্রকাশক এবং লেখকদের সমন্বয়ে পাঠ উপযোগী বই পাঠকদের হাতে আসবে।
টেলিভিশন/মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেয়ার ক্ষেত্রে প্রকাশক এবং বইয়ের স্টল পরিচালনায় নিয়োজিতদের প্রত্যাশার কথাই বলতে শোনা যায়। তবে বই বিক্রির বাজার খুব বেশি একটা ভাল নয়। হয়তো ৫-৭টি প্রকাশনা সংস্থার বই বিক্রির হার বেশ ভাল। বাকিদের অবস্থা খুব বেশি একটা ভাল না। প্রকাশনী সংস্থা আছে, একুশে বইমেলায় বইয়ের স্টল না রাখলে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সকলের নিকট বোধগম্য হবার সুযোগ থাকে না সে বিবেচনায় অনেকেই মেলায় স্টল নিয়ে থাকে। বই বিক্রির সার্বিক পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায় ভাল মানের বই খুব বেশি একটা যেমন আসছে না ঠিক তেমনি ভাল লেখকও বের হচ্ছে না তেমন। তাই আমার কাছে মনে হয়, বইয়ের মেলা না হয়ে পাঠকের মেলা হওয়া উচিত যেখানে উন্মুখ পাঠক আগ্রহ নিয়ে বসে থাকবে বইয়ের জন্য। আর সে জন্য ভাল লেখক এবং ভাল প্রকাশনা সংস্থার প্রয়োজন যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিরাট শ্রেণির পাঠক সমাজ তৈরি হবে বাংলাদেশে। এ কথাটি এ জন্যই বললাম বই মেলাতে যত সংখ্যক পাঠকের সমাগম ঘটে বইমেলার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রত্যেক পাঠক যদি কমপক্ষে ১টি করে বই ক্রয় করে তাহলে অধিকাংশ প্রকাশনা সংস্থা বইমেলা শেষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারতো। কাজেই আমরা প্রত্যাশা করবো পাঠকের মেলা হবে বাংলাদেশে যেখানে পাঠকেরা প্রচলিত রীতিতে লেখকের নাম দেখে নয়, বইয়ের বিষয়বস্তু ও লেখনিশৈলী দেখে বই কেনার প্রতি আগ্রহ দেখাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)