১৯৫২-১৯৮৪ এই ৩২ বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিকিৎসকরা শ্বাসকষ্টের প্রধান চিকিৎসা বিষয়ে বলতেন বিশ্রাম। কিন্তু ১৯৮৪ সালের পর গবেষণালব্ধ প্রমাণের ভিত্তিতে আমেরিকা থোরাসিক সোসাইটি এবং ইউরোপিয়ান রেস্পিরেটটি সোসাইটি প্রচার করতে শুরু করে যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতায় এবং শ্বাসকষ্টে ঔষধের চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীর অবস্থাভেদে ‘পালমোনারী রিহ্যাবিলিটেশন’ রোগীকে সুস্থ্ হতে সাহায্য করে। এই বিষয়টি এখন সকলের কাছে সমাদৃত।
‘পালমোনারী রিহ্যাবিলিটেশন’ শুধু দুই কোটি ফুসফুসের রোগীর জন্য প্রযোজ্য নয় বরং সারা দেশের সকল ক্রণিক রোগী যেমন- ডায়াবেটিস, প্রেসার, হার্র্ট ডিজিজেস, স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, হাড়ভাঙ্গা, বাত ইত্যাদি সকল রোগীর জন্য নির্দিষ্ট পুনর্বাসন কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রয়োজন ‘পালমোনারী রিহ্যাবিলিটেশন’।
এমন প্রেক্ষিতে ‘ফুসফুসীয় পুনর্বাসন’ বা ‘পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন’ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং একইসাথে চিকিৎসকদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুজিব শতবর্ষে দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হচ্ছে ফুসফুসীয় পুনর্বাসন সপ্তাহ ২০২২।
গত ১২ মার্চ মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজে ‘পিওর ফোরাম’ আয়োজিত ‘ফুসফুসীয় পুনর্বাসন’ সপ্তাহ এর উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, এমপি। কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মো. জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে পিওর উইক ২০২২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘সিওপিডি ও পোস্ট-কোভিড নিউমোনিয়া ব্যবস্থাপনায় ফুসফুসীয় পুনর্বাসনের ভূমিকা’ শীর্ষক মূল বক্তব্য তুলে ধরেন পিওর ফোরামের চেয়ারম্যান এবং ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লিমিটেডে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান।
বিশেষজ্ঞ হিসেবে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. মোতাহার হোসেন, হ্নদরোগ বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান, শিশু বিভাগীয় ধান অধ্যাপক ডাঃ নিহার রঞ্জন সরকার এবং বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. বজলুল করিম চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সাইফুদ্দিন আলমগীর।
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড-এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এবং হেড অফ অ্যাডমিন জাহিদুল আলম। ডা. এ জেড এম আহসান উল্লাহ-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি আয়োজনে পিওর ফোরামকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে দেশের স্বনামধন্য ঔষধ প্রস্ততকারক কোম্পানী ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড।
পিওর উইক ২০২২-এর উদযাপনের আওতায় মার্চ ১৩ থেকে পর্যায়ক্রমে ইনজিনিয়াস পালমোফিটে স্পাইরোমেট্রি, সিপিইটি, ডিএলসিও এবং বডি বক্সের উপর হাতে-কলমে প্রিশিক্ষণ কর্মশালাসহ রংপুর, কুড়িগ্রাম, বরিশাল, ফরিদপুর, এনাম মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মডিকেল কলেজ এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ফুসফুসীয় পুনর্বাসন শীর্ষক সেমিনার ও স্পাইরোমেট্টি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় ফুসফুসীয় পুনর্বাসনে ব্যায়াম নিয়ে জনসচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮ মার্চ এক সাইকেল র্যালি অনুষ্ঠিত হবে।
পিওর ফোরামের চেয়ারম্যান এবং ইনজিনিয়াস হেলথ কেয়ার লিমিটেডে চেয়ারম্যান, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান জানান, ১৯৯৯ সালে যখন দেশে ১ম ন্যাশনাল অ্যাজমা প্রিভ্যালেন্স স্টাডি হয়েছিল তখন হাঁপানি রোগীরা প্রতিরোধক ইনহেলার মেডিসিন ব্যবহার করত ১% এরও কম এবং উপশমকারী ইনহেলার মেডিসিন মাত্র ১১% যা ১০ বছর দেশব্যাপী জনসচেতনা কার্যক্রমের পরে প্রতিরোধক ইনহেলার মেডিসিন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১% থেকে ৬৩% এবং উপশমকারী ইনহেলার মেডিসিন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় শতভাগে। অ্যাজমা, সিওপিডি রোগীরা এখন বুঝে গেছে তাদেরকে সুস্থ থাকার জন্য ইনহেলার জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করতে হবে।
তিনি আরো জানান, ২০১৬ সালে ইনজিনিয়াস পালমোফিট গঠনের সময়ে দেশের ডাক্তারদের মাঝে ফুসফুসীয় পূনর্বাসনের প্রয়োজনীয়তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতো ১% এরও কম চিকিৎসক; যা বর্তমানে অনেকাংশেই বেড়েছে। দুই কোটির উপরে অ্যাজমা, সিওপিডি, আইএলডি, পোস্ট-কোভিড ফুসফুসীয় ক্ষত এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসীয় রোগের জন্য ফুসফুসীয় পুনর্বাসনের গুরুত্ব জনগণের সামনে তুলে ধরা এখন অত্যন্ত জরুরি। আর সেই লক্ষ্যেই পিওর ফোরাম ১৩ তেকে ১৯ মার্চ পিওর উইক ২০২২ বা পালমোনারি রিহ্যাবিলিটেশন সপ্তাহ ২০২২ হিসাবে পালন করছে যা ফুসফুসীয় পুনর্বাসন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াবে এবং চিকিৎসকদের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
পিওর ফোরামের চেয়ারম্যান ডা. রাশিদুল হাসান আরও বলেন, ‘মুজিব শতবর্ষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম মাসে এবং মহান স্বাধীনতার মাসে দেশব্যাপী পালমোনারী রিহ্যাবিলিটেশন সপ্তাহ বা পিওর উইক ২০২২ পালনে কিছুটা হলেও সারা দেশের মানুষ সচেতন ও উপকৃত হবে। ফুসফুসীয় পুনর্বাসন নিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা এবং ফুসফুসীয় রোগের সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসাকে সহজলভ্য ও যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে পিওর ফোরামসহ বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। যদি সরকারের সহযোগিতায় পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং অন্তত ৫০ হাজার রেস্পিরেটরি থেরাপিস্ট তৈরি করা সম্ভব হয় এবং সকল হেলথ কমপ্লেক্স ও সকল হাসপাতালে কিছু সাধারণ পরীক্ষা যেমন- স্পাইরোমেট্রি ও সিক্স মিনিট ওয়াক টেস্ট চালু করা যায় এবং সাথে সামান্য কিছু ফুসফুসের ব্যায়ামের ট্রেনিং সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করে করা যায় তাহলে সারা দেশব্যাপী চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক আলোড়ন সৃষ্টি হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা যদি রেসপিরেটরী থেরাপিস্ট তৈরি করে তাদেরকে সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারি তাহলে তারাই হবে ‘রেসপিরেটরী কেয়ার গিভার অব বাংলাদেশ’। নিয়মিতভাবে ফুসফুসীয় পুনর্বাসন সপ্তাহ পালন বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীতে দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানকে অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দীপ্ত প্রয়াস।