১৯৮৭ সালে ‘বখাটে’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে যাত্রা হাবিবুল ইসলাম হাবিবের। বখাটের জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনিত হলেও শেষ পর্যন্ত সে বছর এই বিভাগে পুরস্কার স্থগিত করা হয়। ফলে প্রথম ছবি নির্মাণ করেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনা হাত ফসকে যায়। তবে নির্মাণ থেমে থাকেনি তার। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার না পেলেও অর্জন করেছেন মানুষের অফুরান ভালোবাসা। সম্প্রতি নির্মাণ করেছেন ‘রাত্রির যাত্রী’ নামের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলেও ছবিটি সারা দেশের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে দেখাতে চান নির্মাতা। তার চলচ্চিত্র যাত্রা ও ভবিষ্যত ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে:
আপনার প্রথম কাজতো নব্বইয়ের আগে?
আমি তখন নবীন নির্মাতা। ১৯৮৭ সালে প্রথম আমি নির্মাণ করি ‘বখাটে’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। সে বছর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য মনোনিত হলেও শেষ পর্যন্ত আমাকে পুরস্কারটি দেয়া হয়নি। প্রথমে কাগজেও ঘোষণা আসে, কিন্তু পরবর্তীতে জানানো হয় ‘এ বছর মানসম্পন্ন কোনো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়নি বিধায় কাউকে পুরস্কারটি দেয়া যাচ্ছে না’। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ছিলো এটি। এরপর আমি নির্মাণ করি ‘বিজয় নব্বই’ নামের আরো একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।
সেটা কতো সালে?
১৯৯০ সালে নির্মাণ করি, কিন্তু রিলিজ দেই ১৯৯১ সালে। তখন ক্ষমতায় এরশাদ। সেই ছবিতে প্রথমবার অভিনয় করলেন রোকেয়া প্রাচী। আমার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই অভিনয়ে আসেন। তিনি একজন সাংবাদিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটির দৈর্ঘ্য ছিলো ৪৫ মিনিট।
বহুদিন ধরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ‘রাত্রীর যাত্রি’র ক্যাম্পেইন করতে দেখা গেছে আপনাকে। কিন্তু মুক্তির সময় হল পেলেন মাত্র ১৭টি। এরপরের সপ্তাহে আরো কমে গেল। ছবিটি নিয়ে এখন কোনো ভাবনা আছে কিনা?
এক বছরের বেশি সময় ধরে আমি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় জেলায় ‘রাত্রির যাত্রী’ ছবিটির খবর নিয়ে গিয়েছি। জেলা, উপজেলায় ‘রাত্রির যাত্রী’র সহযোগি টিম রয়েছে, তাদের সহায়তায় আমি প্রেসক্লাব এবং সেখানকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত মানুষদের সাথে কথা বলেছি। সাধারণ মানুষের কথা বলেছি। তারা সবাই ছবিটির জন্য দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছেন। কন্টেন্ট হিসেবে এই ছবিটি দেখার পর তারা পছন্দ করবেন কিনা জানি না, কিন্তু ছবিটি নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ আমি তৈরী করেছি এটাকে খুবই ইতিবাচক ভাবে দেখি। শুধু ‘রাত্রির যাত্রী’ নয়, বাংলা ছবির জন্য মানুষের এই আগ্রহটা দরকার, বিশেষ করে সিনেমার এই দুঃসময়ে। এখন যেহেতু আমার ছবিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে সিনেমা হলের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে পারিনি, তাই এখন নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় সেখানকার জনপ্রতিনিধি ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মানুষের কাছে যেতে চাই। গিয়ে তাদের অনুরোধ করতে চাই, তারা যেন তাদের এলাকার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে ‘রাত্রির যাত্রী’ ছবিটির প্রদর্শনীর পাশে থাকেন। কারণ সেসব এলাকার জনপ্রতিনিধি যদি এসব সাংস্কৃতিক কাজে একটু প্রাগ্রসর না হন, একটু সহযোগি না হন তাহলে সেখানকার সাধারণ মানুষও দিন দিন এসব থেকে বিমুখ হয়ে পড়বে। একের পর এক হল বন্ধের খবর আসতেই থাকবে।
তবে আসার কথা, আমাদের চাওয়ার সাথে অনেকেই একমত হয়েছেন। শিগগির আমরা সারা দেশে ‘রাত্রির যাত্রী’ সিনেমাটি নিয়ে ট্যুরে বের হবো।
তার মানে বিকল্প পদ্ধতিতে এখন ‘রাত্রির যাত্রী’ ছবিটি দেখাতে চাইছেন?
বিকল্প পদ্ধতি বলতে যা বোঝায়, এটা তেমন উদ্যোগ না। আমি সিনেমা হলেই ছবিটি দেখাতে চাইছি। শুধু স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় তাদেরকে ডেকে এনে একটু প্রণোদনা যোগ করা। সাধারণ মানুষের একটু দৃষ্টি আকর্ষণ করা অন্য ভাবে। লোকাল প্রতিনিধি, সমাজ সেবী কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটু জমকালো ভাবে শুরু করা। যেন সাধারণ মানুষ উদ্যোগী হয়ে সিনেমা হল মুখি হয়। দেখেন, বাংলা সিনেমার কিন্তু এখন দর্শক একেবারেই নেই। যে সিনেমায় আসুক, ফ্লপ হচ্ছে। কারো ছবিই কিন্তু এখন আর সেভাবে চলছে না। কালেভদ্রে এক/দুটো ছবি হলে চলে।
আপনি যে পদ্ধতিতে সিনেমা দেখাতে চাইছেন, সেভাবে কি হলে দর্শক আনা সম্ভব?
সম্ভব না, তারপরও একটু চেষ্টা করা। আসলে আমাদের সিনেমায় এখন সুনামি চলছে। এখান থেকে আমাদের ব্যাক করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে সিনেমার যাত্রা, তার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনেমাকে শিল্প ঘোষণা করেছেন। সরকারের তরফ থেকে কিন্তু সিনেমা নিয়ে আন্তরিকতার অভাব নেই বলেই মনে করি। শুধু ঠিকঠাক উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
তো কী মনে করেন, সিনেমা হলে কী করলে আগের মতো দর্শক আনা সম্ভব?
যে রিক্সা চালায়, এখন তার ঘরেও একটা বিশ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন আছে। ঘরে বসে সেই টেলিভিশন দেখে যে আনন্দটা রিক্সাওয়ালা পায়, তারচেয়ে বেশি আনন্দ আর কমফোর্ট যদি সে সিনেমা হলে এসে না পায় তাহলে হলে সে কেন আসবে? এখন মফস্বলতো দূরের কথা, রাজধানীর হলগুলোর সিট আর ভেতরের যে পরিবেশ, তাতে কেন দর্শক আসবে!
দর্শক কেন কমে যাচ্ছে, এমন প্রসঙ্গ আসলেই সবাই হলের সিট, পরিবেশ এর খুঁত ধরেন। কিন্তু বাংলা সিনেমায়তো সবচেয়ে বড় ঘাটতি ভালো সিনেমা তৈরীর। সেটাইতো হচ্ছে না?
তাতো অবশ্যই। সিনেমা ভালো করার সাথে আরো কিছু কথা আছে। সিনেমার যে তথাকথিত আড়াই ঘন্টা, তিন ঘন্টার গৎবাধা ধারনা এগুলোরও পরিবর্তন দরকার। এতো সময় মানুষের হাতে নাই। তিন ঘন্টা সময় একটা মানুষ কেন বন্দি হতে চাইবে! এন্টারটেইন করার জন্য আগের যে তিন ঘন্টার ধারণা, এগুলো থেকেও বের হয়ে আসতে হবে। এখন ম্যাক্সিমাম দুই ঘন্টা একটা ছবি হতে পারে।
এছাড়াও আরেকটি কথা, সেন্সর বোর্ডকেও উদার হতে হবে। আমরা ইচ্ছে করলেই অনেক বিষয় সিনেমায় আনতে পারছি না। সিনেমার কথা উঠলেই সবাই পাশের দেশের দোহায় দিচ্ছেন, তাদের উন্নতি আমাদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে কিন্তু একটা বিষয় কেউ ভাবছে না, পাশের দেশে কিন্তু যে কোনো সাবজেক্ট নিয়েই সিনেমা হচ্ছে।
হ্যাঁ। তা হচ্ছে। নানা বিষয় নিয়ে গল্প নির্ভর ও এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা অনবরতই হচ্ছে…
তাদের সিনেমার বিষয় খুব বৈচিত্রপূর্ণ এবং একই সঙ্গে চমকপ্রদ। কিন্তু আমাদের? সেই মারামারি, খুনাখুনি, হিরো ঢিুসম ঢিুসম করলো, নায়িকার সাথে গান গাইলো, দৌড়ালো, এগুলো আমাদের মেইনস্ট্রিম সিনেমা। আবার আর্টফিল্ম যেগুলো নির্মিত হচ্ছে, বেশির ভাগের মধ্যে মানুষ ভাত পাচ্ছে না, কাপড় পাচ্ছে না, হাহাকার করে মরছে, ভাটিয়ালি গান গাইছে এরকম প্রথাগত সিনেমা। এগুলো কেমন সিনেমা? এর বাইরে আমরা যেতে পারছি না। কিন্তু দেখুন, একজন রাজনীতিবীদ ঘুষ খাচ্ছে, সোসাইটিকে নষ্ট করছে, একজন ডাক্তার রোগির সেবা না দিয়ে যাচ্ছে তাই করছে, ঘুষ খাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার তার কাজ করছে না, অভিনেত্রী শুটিং না করে আটকে দিচ্ছে কিংবা একজন পুলিশ অফিসার আরেকজন বদ অফিসারের প্রলোভনে পাত্তা না দিয়ে নিজের সততাকে রক্ষা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এগুলো কই আমাদের সিনেমায়? সোসাইটিতে অসংখ্য ক্যারেক্টার বাস করে, প্রতিনিয়ত তাদের সাথে আমরাও বাস করছি অথচ আমাদের সিনেমায় সেগুলো অনুপস্থিত। অথচ একজন নির্মাতা সব চরিত্র তার সিনেমায় তুলে ধরার স্বাধীনতা রাখেন। কিন্তু সেগুলো তুলে ধরলেই সমস্যা। অথচ টক শোতে সবাই সবকিছু বলতে পারছে, একজন আরেকজনের গোষ্ঠি উদ্ধার করছে, রাজনৈতিক ময়দানে একজন আরেকজনকে ধুয়ে দিতে পারে অথচ সেগুলো সিনেমায় দেখালেই যতো ঝামেলা। আমি মনে করি, এসব বিষয়ে আরেকটু উদার হওয়া প্রয়োজন আমাদের সেন্সর বোর্ডের।
সবাই বলছেন, বাংলাদেশের সিনেমার এখন দুঃসময়। এই মুহূর্তে উত্তরণের কোনো পথ জানা আছে আপনার?
বাংলাদেশের তিনশো আসন, আমি মনে করি এই মুহূর্তে যদি প্রতিটি আসনে একটি করে সিনেপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নিলে সারা দেশে বিপ্লব ঘটে যাবে। সিনেমার চেহেরাই পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি বহুদিন ধরেই সময় সুযোগ পেলেই এমনটা বলে আসছি যে, দেশের প্রতিটি আসনে একটি করে সিনেপ্লেক্স হোক।