সাধারণ আর দশজন মানুষের মতো আমার মনেও কিছু কষ্ট মাঝে মাঝেই নাড়া দেয়। প্রশ্ন তৈরি হয়। কাছের মানুষগুলোর সাথে শেয়ার করি। আজ বলতেই হয়, আর পারছি না- এ আমরা কেমন দেশে বাস করছি! একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে, আমরা দেখছি, কষ্ট পাচ্ছি, ফেসবুকে সংবাদপত্রে লেখালেখি হচ্ছে, টিভিতে রাতে টকশোগুলো বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনায় মুখর হচ্ছে। প্রথমদিন ঘটনাটি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায়, টিভি নিউজের টপনিউজ হচ্ছে, তারপর একদিন কোথাও নেই, না সংবাদপত্রের শেষ পাতায়ও তার ঠাঁই হয় না। বছরান্তে কেবল দিবস পালনের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে বাংলাদেশের প্রতিটি লজ্জাজনক, কলঙ্কজনক ঘটনা।
সাল ২০০৯ এর ২৫ ফেব্রুয়ারি, সেদিন সূর্য ঠিক সময়েই উঠে সকাল এনেছিলো। রিমঝিম তখন একাডেমিয়াতে নার্সারিতে (ধানমন্ডি ৯/এ ) পড়ে। তাই পড়ালেখার তেমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। সকালে উঠতে পারিনি, তাই স্কুলে যাওয়া হলো না। সকাল ৯টার কিছু পর, পাড়ার আনোয়ারের দোকানে হৈ-চৈ শুনে বারান্দায় যাই এবং দূরের কোন রাস্তায় টায়ার ফাটার মতো কয়েকটা আওয়াজ পাই। রুমে এসে দেখি ততোক্ষণে সবাই টিভির সামনে দাঁড়িয়ে। রিমঝিমের বাবা তখন চ্যানেল আইয়ে কাজ করেন, তার কাছে শুনি পিলখানায় বিদ্রোহ হয়েছে। তখনো কোন হতাহতের ঘটনা জানি না। সেদিন মেয়েকে স্কুলে পাঠাইনি বলে কিছুটা শান্তি লাগছিলো। স্কুল ছুটি হয়ে গেলেও বাচ্চা ছেলে-মেয়েগুলোকে নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন অনেকে। তবে পরে যে খবর পেলাম, অনেক-অনেক বাচ্চার এতিম হয়ে যাবার খবর পেলাম, অনেক মেয়ের বিধবা হয়ে যাওয়া, সে তুলনায় এটাতো কিছুই না।
সেদিনটার কথা আজ আবার মনে পড়ছে। রান্না-বান্না কিছুই হয়নি। প্রথমে উদ্বেগ আর পরে শোক গ্রাস করে নিয়েছিলো সবাইকে। পরের কয়েকদিনও এভাবেই চলেছে। শুধু আমাদের বাসায় নয়, আমার ধারণা সারা বাংলাদেশের প্রতিটি পরিবারের চিত্রই সেদিন এমন ছিলো।
শোকে কাতর হওয়ার পরের ঘটনাও ফেব্রুয়ারি মাসে। ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ সাল। সকাল ৮টার দিকে বাসার সবাই তখনো ঘুমে। আমি সকালে ওঠা মানুষ বলে জেগে আছি। এমন সময় ময়মনসিংহ থেকে আমার বোন ইতির ফোন। ও শুধু বললো টিভি খুলে দেখ তোদের রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি খুন হয়েছে, তোদের বোধহয় পরিচিত। তখনো আমার জীবনের চরম ধাক্কা খাওয়া বাকি আছে। আমি সাথে সাথে টিভি খুলে যা দেখেছি, তাতে বাকহারা হয়ে গেলাম। জুয়েলকে ডেকে উঠিয়ে শুধু বলতে পারলাম, দেখোতো এটা আমাদের সাগর-রুনি না! আমার চাইতেও বড় ধাক্কা সইতে হলো জুয়েলকে। সে রাতের পোশাকেই কোন একটা শব্দ উচ্চারণ না করেই বেরিয়ে গেল ওদের বাসায়। এর মধ্যেই টিভির খবরে যা জানার জেনে গেলাম। কে বা কারা রাতে বাসার ভেতরে ঢুকে ওদের মেরে ফেলেছে। আমার কেবল তখন চিন্তা হচ্ছিল ছেলেটা কেমন আছে? ওর মনের ভেতরে কী হচ্ছে? মেঘ আজ সব জানে, বোঝেও বোধ হয়। সাগর-রুনি ছাড়াই বড় হচ্ছে ওদের রাজপুত্র।
খুবই সাধারণ দুটো মানুষ এরা কার শত্রু হলো? কখন হলো? ভেবে আজও কুলকিনারা পাই না। রুনির মুখের হাসি আমি আজো ভুলতে পারি না। সে আমার কাছে দুটো কাঠের চামচ কিনে দেয়ার আবদার জানিয়েছিলো। দেয়া হয়নি, কোনোদিন হবেও না। সে এখন আমাদের এ দুনিয়ার সংসারে নেই। সে সময় আমি কিছুদিন অপ্রকৃতস্থের মত আচরণ করেছি। গরম চলে আসলেও জানালা দরজা বন্ধ করে ঘুমাতাম, সব সময় ভয় কাজ করতো। আজ আমি আবার স্বাভাবিক, আর এভাবেইতো চলছে আমাদের জীবন।
তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে খুঁজে বের করা হবে। আজ ২০১৬। এখনো হত্যাকারীর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি, বিচারতো দূরের কথা। এ কেমন দেশে আছি আমরা যেখানে মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই! বিচার নেই!
আজ আবার তনু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা আবারো প্রশ্নবিদ্ধ। পত্রিকায় আজ পড়লাম, তনুর মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত। এই কথাটার অর্থ আমি বুঝে পাচ্ছি না। মেয়েটি যে খুন হয়েছে সেটা যারা ময়না তদন্ত করলেন তারা কি বুঝতে পারলেন না! নাকি কারো ফরমায়েশি উত্তর দিলেন? আবার রহস্য রয়েই গেলো।
আজ কারো ব্যক্তি অপরাধে যে সেনাবাহিনীর দিকে কেউ কেউ আঙুল তুলছেন এটা নিশ্চয়ই তাদেরও ভালো লাগছে না। সেনাবাহিনী প্রমাণ করে দিকে এখানে কোনো লুকোচুরি নেই। তারা প্রমাণ করে দিক তারা কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে না। এ সেনাবাহিনীকে আমরা দেশের প্রতিটা দুর্যোগে সবার আগে মানুষের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখি। যারা রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে সেই মানবিক সেনাবাহিনীকেইতো মানুষ চেনে। রেশমাদের মতো সাধারণ মেয়েদের জীবন বাঁচাতে যারা জীবন বাজি রাখতে পারে, তারা কেনো আরেকটা মেয়ে তনু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেদের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ করে দেবে!
সেনাবাহিনীর মতো স্বজন হারানোর কষ্ট আর কার বেশি জানা আছে! তারা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে, তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে জীবন দিয়েছে, তারা দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছে। যখন পিলখানা হত্যাকাণ্ড হয়েছিলো দেশের প্রতিটি মানুষ কি কাঁদেনি? তাদেরকেতো আমরা আলাদা ভাবি না। তারা কেন নিজেদেরকে দেশের মানুষ থেকে আলাদা ভাববে? তারা কি আলাদা কোনো জাতি, অন্য কোনো দেশের? তারা অন্যদের চেয়ে অনেক ঝুঁকির আর গৌরবের কাজ করে। কিন্তু, এই দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়েইতো তাদের সংসার চলে, তাদের রেশন হয়। তাদেরকে বুঝতে হবে, অনেক মানুষের মনে হচ্ছে যে, তনু হত্যাকে তারা আর দশটা হত্যাকাণ্ডের মতো বিবেচনা করছে না, সত্য-মিথ্যা যাই হোক, এ ধারণা যে ভুল সেনাবাহিনীকেই সেটা প্রমাণ করতে হবে।
অনেকের মনে হচ্ছে, প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতো তনু হত্যা রহস্যও উন্মোচিত হবে না? অনেক ঘটনার পরই ঘটনার রহস্য উন্মোচিত হয় না কেনো? তদন্ত শেষ হয়েও শেষ হয় না কেনো? তদন্ত হলেও সঠিক প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব হয় না কেনো? আমরা কতো ঘটনায় কতোদিন এভাবে অন্ধকারে থাকবো?
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমাদের আইন নাকি সেকেলে হয়ে গেছে। এই আইনে তনু হত্যার সুষ্ঠুু বিচার সম্ভব নয়। এবং একই কারণে নাকি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচার হয়নি।
তাহলে টিভি খুললেই যে প্রায়ই আরো একটা নতুন আইন হয়েছে খবর দেখি- সেসব কি শুধু মন্ত্রী-এমপিদের সুবিধার জন্য? অসৎ ব্যবসায়ীদের কালো টাকা সাদা করার জন্য! আমরা সাধারণ মানুষ, আমরা অতোকিছু বুঝি না। সংসদে বসে যতো আইনই বানান তাতে কী হবে যদি তনুর মা-বাবা কিংবা সাগর-রুনির মেঘ বিচার না পায়! পিলখানা হত্যাকাণ্ডের শহীদ সকল সেনা কর্মকর্তা আমাদের ভাই। তেমনি তনুও আমাদের বোন। রুনি-সাগরও আমাদের বোন আর ভাই। পিলখানা হত্যকাণ্ডের বিচার হয়েছে, তনু এবং সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। পিলখানায় শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের উত্তরাধিকার সেনাবাহিনীকে বুঝতে হবে তনুর জন্য আজ এক হয়েছে বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)