ডাকসু নির্বাচনে যে অনিয়ম ও কারচুপি হয়েছে, এ বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই। কুয়েত-মৈত্রী হলে ভোট শুরুর আগেই সিল-মারা ব্যালট-ভর্তি বাক্স পাওয়া গেছে। রোকেয়া হলেও তিনটি ব্যালট-ভরা বাক্স উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও ব্যালটগুলোতে সিল মারা ছিল না।
দুটি হলেই এই ব্যালট বাক্সগুলো উদ্ধার করেছে শিক্ষার্থীরা। অন্য হল বা ভোটকেন্দ্রে যে তেমন ঘটনা ঘটেনি-একথা কে বলবে? এ ছাড়া হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, অন্য সংগঠনের কর্মীদের অবাধে কাজ করতে না দেওয়া, ভোটের দিন মোটরসাইকেলে মহড়া, প্রতিটি হলে এবং ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ব্যাজ লাগিয়ে দাপট দেখানো, দলের কর্মীদের দিয়ে কৃত্রিম লাইন তৈরি করা, ভোট দিতে কৃত্রিমভাবে সময় বেশি নেওয়া (যাতে অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে ভোট না দিয়ে ভোটাররা চলে যান) ইত্যাদি নানা অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে।
এই অনিয়মগুলো এতটাই প্রকাশ্য ছিল, এর জন্য বিশেষ কোনো তদন্ত বা গবেষণা করার দরকার হয় না। দেশের প্রায় সবগুলো মিডিয়ায় এসব ঘটনার খবর ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে, বিভিন্ন টেলিভিশনে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য প্রচার করা হয়েছে, যারা এই অনিয়মের কথা প্রকাশে বলেছেন।
কাজেই ডাকসু নির্বাচনে ফল যাই হোক, তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কোথাও একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যাচ্ছে। ডাকসুতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রাপ্ত ভোটও ঠিক ‘বিশ্বাসযোগ্য’ মনে হয়নি। প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রদলের গড় ভোট মাত্র আড়াইশর কাছাকাছি!
আমাদের চারপাশের পরিচিতজনদের মধ্যে যদি একটা জরিপ চালান, তাহলে দেখবেন, এখনও শতকরা প্রায় ৩০-৩৫ ভাগ মানুষ বিএনপিকে সমর্থন করে। আর যদি আওয়ামী লীগবিরোধীদের হিসেব নেন, তাহলে এই হার ৭০ ভাগের বেশি। তাহলে ডাকসুর এই ফল বিশ্বাস করি কিভাবে?
অনেকে বলবেন, প্রায় এক যুগ ধরে ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের কোনো কার্যক্রম নেই, শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের কোনো ইতিবাচক ভাবমূর্তি নেই, মূল দল বিএনপির কোনো নীতি-আদর্শ নেই, দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে দলের প্রধান নেত্রী জেলে, দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা ফেরার, সেই দলের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো সমর্থন না থাকারই কথা। উল্লিখিত যুক্তি আদতেই কি বাস্তবের সঙ্গে কি সঙ্গতিপূর্ণ? আর ছাত্রলীগ কি আসলেই ক্যাম্পাসে এতটা জনপ্রিয়?
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের নিশ্চয়ই অনেক কৃতিত্ব ও সাফল্য আছে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে নিজেদের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা খোয়ানো। দেশের বেশিরভাগ মানুষ ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাস করে না। ভালো কাজ করলেও না। মন্দ তো নয়ই। যোগ্য বিকল্পের অভাবে হয়তো মানুষ তাদের মেনে নিচ্ছে। মেনে নিচ্ছে বলে তাদের পছন্দ করছে বা ভালোবাসছে-তা কিন্তু না। বরং ক্ষোভ আর ঘৃণার বারুদ নিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়! ঘাড় থেকে এ বোঝা নামানো যায়!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের প্রতি তাদের ক্ষোভের পরিমাণ কত বেশি। তাদের ক্ষমতার দাপট, দম্ভ, স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অপকর্মে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। ছাত্রলীগের রাজনৈতিক চালবাজিতেও শিক্ষার্থীরা বিরূপ। সম্প্রতি সংঘটিত আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোটা সংস্কার এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল হঠকারী আর চালাকিতে ভরা। এই দুটি বিষয়ে তারা তাদের অবস্থানও পরিষ্কার করতে পারেনি। সকালে হয়তো বলেছে কোটার আন্দোলনকারীরা শিবির, বিকেলে বলেছে এটা আসলে আমাদের আন্দোলন। আগের দিন তারা কোটা-সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালিয়েছে, পরদিন কোটা বাতিলের পর অভিনন্দন বার্তা দিয়েছে। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও একপর্যায়ে তারা শামিল হয়েছে, পরে আবার আন্দোলনকারীদের পিটিয়ে রাজপথ ছাড়া করার ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। একইভাবে সদ্য নির্বাচিত ডাকসু ভিপি নূরুল হককে কখনও শিবির বলে গালি দিয়েছে, কখনও বলেছে, সে আসলে ছাত্রলীগ। এই দ্বিচারিতার কারণে তরুণদের কাছে তারা মোটেও জনপ্রিয় হতে পারেনি।
এই ছাত্রলীগ ডাকসুতে ভিপি ছাড়া আর সব পদে বিপুল ভোটে জয়ী হবে-এটা বিশ্বাস করা কঠিন। অনেকে বলাবলি করছেন যে, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব দলের নির্বাচন বর্জনের মুখে রাতে যখন ক্রমেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হচ্ছিল, তখন সম্ভাব্য অসন্তোষ ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তেই নুরুল হক নুরকে ভিপি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্যই ডাকসুর চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করতে রাত তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
নির্বাচনের পরদিন বিকেলে নূরকে লাঠিসহ ধাওয়া দেওয়া, শিবির হিসেবে চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের দাবি তোলা, এর পর সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ সভাপতির আগ বাড়িয়ে এসে নূরের সঙ্গে কোলাকুলি-এটাও ক্ষমতাসীনদের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তেই হয়েছে বলে কানাঘুঁষা চলছে।
উল্লিখিত বিষয়গুলো হয়তো শুধুই রটনা। কল্পনা মেশানো গল্প। সত্য হয়তো সেটুকই যেটুকু প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। তারপরও ডাকসু নির্বাচনের ফল নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর অবিশ্বাস রয়েছে। এই অবিশ্বাস দূর করার মতো কোনো ম্যাকানিজম এবং ইমেজ সরকারের যেমন নেই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষেরও নেই।
‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ডাকসু নির্বাচন ও নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা জন নানা ধরনের ব্যাখা-বিশ্লেষণ দাঁড় করছেন। কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি এবং বাম সংগঠনগুলোকে ‘জিরো’ বানানোর কৌশল হিসেবে সরকার শুধু নূরকে জিতিয়ে কোটা-সংস্কার আন্দোলনকারীদের হাতে রাখার চেষ্টা করেছে। বাকি সব গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাত্রলীগকে দিয়ে ‘তালগাছ’টাও নিজেদের হাতেই রেখেছে। আবার অনেকে আবার এই নির্বাচন থেকে অনেক তাৎপর্য খুঁজে বের করা চেষ্টা করছেন। কারও কারও মতে, প্রতিরোধ করা গেলে প্রশাসন যত পক্ষপাতিত্বই করুক সেটা ঠেকানো যায়, ডাকসুতে কুয়েত-মৈত্রী হলের ছাত্রীরা তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তারা হল-প্রশাসনের সব নীলনকশা জাতির সামনে শুধু উম্মোচনই করেননি, পাশাপাশি তারা দাবি আদায় করে নিয়েছেন। হলের প্রভোস্টকে অপসারণ করতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি ছিল হলের প্রভোস্টকে অপসারণ এবং সেদিনই নির্বাচন করা। তাৎক্ষণিক নতুন প্রভোস্ট নিয়োগ দিয়ে ভোট শুরু করতে হয়েছে। এই হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন। ছাত্রলীগের প্যানেলের ভরাডুবি হয়েছে। এটা হচ্ছে প্রতিরোধের সফলতা।
কোনো বিশ্লেষকের মতে, রুখে দাঁড়াতে পারলে আর সমর্থন থাকলে যে কর্তৃপক্ষও ভয় পায় তার প্রমাণ নুরুলকে ভিপি হিসেবে ঘোষণা দেওয়া। পরিস্থিতি বেসামাল হতে পারে মনে করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নূরুলের বিজয়কে ছিনিয়ে নিতে ভয় পেয়েছে। অনেকে আরেকটি বিষয়কে বড় করে দেখছেন তা হলো- শিক্ষার্থীদের চাকরির ইস্যুর জনপ্রিয়তা। জাতীয় কোনো দাবি নয়, কেবল কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে মাঠে নেমে বিপুল সমর্থন পেয়েছেন কোটা-সংস্কার আন্দোলনের নেতারা। নুরুল হক সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিত হয়ে উঠেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাই সাধারণ শিক্ষার্থীরা তার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।
নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে হয়তো কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্যানেল বিজয়ী হতো বলেও অনেকে গ্যারান্টি দিচ্ছেন। তাদের মতে, অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে প্যানেলের অন্যদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারপরও গুরুত্বপূর্ণ পদ ভিপি ছিনিয়ে নিতে সাহস করেনি। এটা নুরুল হকের জনপ্রিয়তার সাফল্য।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এমনি অসংখ্য মত ও বিশ্লেষণ চলছে। কেউ কেউ ছাত্রলীগের সভাপতির ভূমিকার প্রশংসা করছেন। কেউ কেউ নুরুল হকের মধ্যে ভবিষ্যৎ ‘জননেতার ছায়া’ দেখছেন। কেউ কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের ‘বিজয়’ দেখছেন। আবার অনেকে ব্যঙ্গ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যকে ‘বিজয়ী’ বলছেন দক্ষতার সঙ্গে এমন একটি নির্বাচন ও নির্বাচনের ফল উপহার দেওয়ার জন্য!
সত্যিই কি ডাকসুতে কেউ বিজয়ী হয়েছে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, সকল ছাত্রসংগঠন, নীতি-নৈতিকতা-আদর্শ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, গণতন্ত্র চর্চার পরিসর-সবাই, সবকিছুরই পরাজয় ঘটেছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।