নিখোঁজ শিক্ষক ও গবেষক মোবাশ্বের হাসান সিজারের জন্মদিন উপলক্ষ্যে সিজারের বোন তামান্না তাসনিম তার ফেসবুক আইডি থেকে সিজারকে নিয়ে মায়ের একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
সন্তানকে ফিরে পাওয়ার ব্যাকুলতা জানিয়ে সিজারের মা লেখেন:
সদ্য সমাপ্ত হলো ৪৬ তম মহান বিজয় দিবস। এই দিন সিজার ছাদে উড়াতো জাতীয় পতাকা, গাড়ীতে লাগাতো, মাথায় বাঁধতো আর গায়ে গেঞ্জি পড়তো লাল সবুজের। সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে ধারণ করতো মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে। কিন্তু এই মহান বিজয় দিবসে কোথায় রইল সে? এখন আমার মনে পড়ছে, ওর বয়স যখন দুই সে সময়ের কথা- আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম, দিনাজপুরের অদূরে বিরলে। বড়ভাই মরহুম সাদেক মজুমদারের শ্বশুরবাড়ি সেখানে। সে সময়, ওদের এক প্রতিবেশী সিজুকে আমার কোলে দেখে মন্তব্য করে, ‘তোর কোলত্ ছোয়াখান মানাছেনা বাহে (তোর কোলে বাচ্চাটাকে একেবারেই মানাচ্ছে না রে) -মানাচ্ছে না তো বটেই! রাজপুত্র কে তো রাজরানীর কোলেই মানায়! আমার মতো সাধারণ মহিলার কোলে কি মানায়? তাই কি আমার রাজপুত্রকে কেউ বা কারা সরিয়ে রেখেছে আমার কাছ থেকে ৭ নভেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত।
ছেলে দেখতে আমার মতো হয়নি। হয়েছে ওর বাবার মতো উজ্জ্বল গৌরবর্ণের। কালো মেয়েদের বিয়ের সময় গায়ের রং একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হলেও, সেই আশির দশকে আমার শশুর মরহুম মোয়াজ্জেম হোসেন অবলীলায় বলেছিলেন, ‘মেয়ে কালো হলেও বিয়েতে আমাদের আপত্তি নাই। আমাদের ছেলে তো ফর্সা’। বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই আমার কোল আলো করে আসে সিজুমনি। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাওয়া সন্তানকে কোলে নিয়ে ভুলে গিয়েছিলাম অস্ত্রোপচারের দুঃসহ যন্ত্রণা। মনে হলও কেউ যেন একটা প্রস্ফুটিত গোলাপকে আমার কোলে দিল।
সে সময় মাতৃত্বকালীন ছুটি ছিল মাত্র তিন মাস। দেখতে দেখতে ছুটি ফুরিয়ে গেল। চাকুরী, সংসার, ছোট্ট সিজুকে বড় করা এসব নিয়ে একেবারে হিমশিম খাওয়ার মত অবস্থা। ‘ও’ একটু বড় হওয়ার পর আর আমাকে অফিস যেতে দিত চাইতো না। নতুন নতুন খেলনা এনে লুকিয়ে রাখতাম। অফিসে বের হওয়ার আগে ওর হাতে নতুন খেলনা গুজে দিয়ে ছুটতাম অফিসের উদ্দেশ্যে। এরপর স্কুলে ভর্তির যুদ্ধ। ভালো স্কুলে ভর্তির পর এসএসসি পরীক্ষার সময় বললাম, ‘যদি তিনটা লেটার পাও তবে সাইকেল কিনে দিব’। কারণ ওর সাইকেলের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। রেজাল্ট বের হলে, ‘ও’ পেল চারটা লেটার। হেসে বলল, ‘এবার কি দিবা বলো’।
কলেজে ভর্তির সময় ঢাকার দুটি বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই সিজু চান্স পেল। ঢাকা কলেজ ও নটরডেম কলেজ। ওর ইচ্ছা ছিল ঢাকা কলেজে পড়ার। কিন্তু বাসার কাছে বলে, আমারা জোর দিলাম নটরডেম কলেজকে। ভর্তি হলও নটরডেম কলেজে ঠিকই। কিন্তু অভিমান করে দু’দিন কথা বলেনি আমাদের সাথে। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যেন ওর একটা স্বপ্ন ছিল। বলতো, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বাবা, মা ও কাকা সবাই পড়েছে। আমিও পড়বো’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে আনন্দিত ছিল সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করার পর বিদেশ গমন, উচ্চতর ডিগ্রি লাভ, ভালো চাকুরী সবই হলও। কিন্তু এ কি হলও! আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাত! আমার চারদিক আঁধারে ঢেকে গেল কেন? কোথায় আমার নাড়িছেঁড়া ধন? যারা ওকে আটকে রেখেছেন তাদের বলছি- যদি আপনার আদরের সন্তানটিকে আপনার স্ত্রীর কোল থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে চায় তবে আপনার হৃদয়ের তন্ত্রীতে কি ঘা পড়বে না? পড়বে ঠিকই। নিজেকে প্রশ্ন করি একজন অসহায় মায়ের আর্তনাদ কি আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌছাবে না?
সিজারের জন্মদিন আজ। ও যখন ছোট ছিল, ওর জন্মদিনে আমাদের বাসায় ছোটখাটো একটা আনন্দ উৎসবের আয়োজন হতো। আশেপাশের প্রতিবেশীদের ছোট ছেলে-মেয়েরা ছাড়াও নিকট আত্মীয়রা বাচ্চাদের নিয়ে হাজির হতো। বড়ো হবার সাথে সাথে উৎসবের ধরণ পালটালেও নিজেদের মতো করে বাসায় আয়োজন করতাম। কিন্তু এখন বাসায় পিন পতনের নিস্তব্ধতা। বাসায় যে কজন প্রাণী আছি- তারা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না, নিতান্ত জীবন ধারণের জন্য যে টুকু প্রয়োজন;এর বাইরে কোন রান্না-বান্না হয়না। উন্নতমানের খাবারে কোন আগ্রহ কিংবা রুচি কোনটাই নাই। চাপচাপ ব্যথার পাহাড় বয়ে বেড়াচ্ছে সবাই। মহান বিজয়ের মাসে আবারো অনুরোধ করছি, আমাদের ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।