চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ঘটনাচক্রে একজন শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প

আজম চৌধুরী: প্রথম দর্শনে ফাওয়াজ রবকে আপনার একজন রাশভারী লোক বলে মনে হবে। তিনি নিজেকে নিয়েই মেতে থাকেন। কারণ তিনি জানেন তার শিল্প কর্মের মাঝেই ধরা থাকবে সময়ের ছায়া।

নিজের প্রতিভা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহল। আর সেই জন্যই সমাজ কি ভাবলো- তাকে তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। চলমান বিষয় নিয়ে খুচরো আলাপেও তার বড্ড অনীহা।

আমি যখন তার সাথে দেখা করতে যাই তখন তার তৃতীয় কথাটাই ছিলো ‘আপনি কি জানতে চান? নিঃসঙ্কোচে আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করুন। যে প্রশ্নটা শেষে করবেন বলে জমিয়ে রেখেছেন তা এখনই করে ফেলুন।’

ফাওয়াজ রবের এমন কথার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তাই গুছিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগলো। আমি এখন পর্যন্ত ২০ জনের মতো শিল্পীর সাক্ষাতকার নিয়েছি। তবে তাদের মাঝে কেউই এতোটা সরাসরি ও ভাবলেশহীন ভাবে আমার সাথে কথা বলেননি।

সাধারণত শিল্পীরা সাংবাদিকদের সাথে বেশ হাসিখুশি ও আন্তরিক ব্যবহারই করে থাকেন। বিশেষত সে সকল শিল্পীরা যারা মিডিয়া কভারেজের মাধ্যমে নিজেদেরকে প্রচারের আলোয় রাখতে চান। আজকের দিনে সবাই মিডিয়া আর সোস্যাল মিডিয়াকে সমীহ করে চলে।

“বেশ তাহলে, বলুন আপনি আপনার শিল্পকে কেন অন্যদের থেকে মহত্তর বলে মনে করেন?” আমি বিচলিত না হয়ে তার কথার জবাবেই তাকে প্রশ্ন করলাম।

“না, আমি এরকম কিছু ভাবি না। বরং আমি এটা মনে করি আমার চেয়েও ঢের প্রতিভাবান শিল্পী আমাদের আশেপাশেই আছেন। আমি কোন প্রতিযোগিতায় নামি নি। এটা ১০০ মিটার রেস না।”

“যদি তাই হয় তাহলে আমরা কেন আপনার শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করবো?”
এই প্রশ্নেও আমি তার মাঝে হেলদোল দেখলাম না।

“আপনি না চাইলে আমার কাজ নিয়ে কথা নাই বলতে পারেন। এসব নিয়ে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।”
“তাহলে আপনি আপনার শিল্পকর্ম নিয়ে কি বলতে চান?”
“কিছুই না।”
“আপনার শিল্পকর্ম আসলে কিসের প্রতিনিধিত্ব করে?”
“কারুর ই না।”

“আপনি কাদের সাথে আপনার শিল্পকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন?”
“কারোর সাথেই না।”
“তাহলে কেন আপনি শিল্প সৃষ্টি করেন?”
“এর পেছনেও কোন কারণ নেই।”
নাহ, আর পারা যাচ্ছে না। আমরা আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছি। সাধারণত এই চারটি প্রশ্ন শিল্পীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যস্ত রাখে। তারা তাদের বিশ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে কথা বলেন। শেষ যে শিল্পীর সাক্ষাতকার আমি নিয়েছিলাম তিনি প্রায় ৩ ঘণ্টার  মতো সময় নিয়েছিলেন। আমার রেকর্ডারের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর এই শিল্পী আমাকে কোন কিছুই বলছেন না।
ফাওয়াজ রব নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। তিনি প্রোডাক্ট ডিজাইন নিয়ে পড়াশুনো করেছেন সান ফ্রান্সিস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। আর স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতোকত্তর করেছেন ইতালিয়ান একটি ইন্সটিটিউট থেকে।

তার প্রথম একক প্রদর্শনী আয়োজিয় হয় প্যারিসে। যা Le Parisien ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল। ফাওয়াজ অনেক ইউরোপীয় শহরে বসবাস করেছেন। তার শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে বুদাপেস্ট, জাদার, প্যারিস, কাঠমাণ্ডু, ইস্তানবুল, এ্যাথেন্স, নমপেন এবং ঢাকায়।

তার দ্বিতীয় প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ক্রোয়েশিয়ায়। সেই দেশে এটাই ছিল কোন বাংলাদেশি চিত্রকরের প্রথম উন্মুক্ত প্রদর্শনী। শিল্পী ফাওয়াজ রব তার যৌবনে বিবাগীর মতো দীর্ঘদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে। তিনি চোস্ত ইতালিয়ানে কথা বলেন এবং ফ্রান্সে তার একটি বাড়িও আছে।

ফাওয়াজ একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী এবং তিনি নিজেকে শিল্পের দুনিয়ায় একজন বহিরাগত হিসেবেই দেখেন। তিনি ভাস্কর হামিদুজ্জামানকে তার গুরু মানেন এবং তার গুরুর মতোই প্রতিদিন কিছু ঘণ্টা শিল্প নির্মাণে ব্যায় করেন।
ফাওয়াজ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন প্রায় ১০ বছরের উপর। এখন তিনি শিক্ষকতা থেকে বিরতি নিয়ে পুরোদমে শিল্পচর্চায় মনোনিবেশ করেছেন।

তার ব্যাপারে খুব সহজেই যা বলা যায় তা হলো, “তিনি (ফাওয়াজ) একজন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ। সব কিছুকেই তিনি বেশ হালকা মেজাজে উপভোগ করেন, যেন আশেপাশে ভয় পাবার মতো কিছুই ঘটেনি।” তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের কাছে একজন সম্মানিত শিক্ষক এবং তার অল্প কিছু শিল্পী সুহৃদ আছেন যারা তাকে ভালোবাসেন।

এগুলোই আমি ইন্টারনেট এবং তার বন্ধুদের কাছ থেকে আলাপ আলোচনা করে জানতে পেরেছি। কিন্তু আমি সরাসরি তার কাছ থেকে কিছু জানতে চাইছিলাম।
“আপনি কি আমার প্রশ্ন গুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন?”
“অবশ্যই না।”
“আপনার স্থাপত্যবিদ্যার প্রেক্ষাপট কি আপনার শিল্প নির্মাণে প্রভাব ফেলে?”
“হ্যাঁ। সব কিছুই আমার শিল্পে প্রভাব বিস্তার করে।”
“আপনি কি আপনার শিল্প নিয়ে কোন কথা বা কিছু কিছু বলতে চান?”
“অবশ্যই। এ গুলো অসাধারণ এবং আপনার একটা কেনা উচিত ।”

এই জায়গায় আমি আমার হাসি আটকাতে পারলাম না। তিনিও হেসে ফেললেন। আর শেষ পর্যন্ত যা বুঝতে পারলাম এই মানুষটিকে কোন প্রথাগত আলোচনায় আটকে রাখা সম্ভব নয়। এই মানুষটি স্বাভাবিক শিল্পালোচনায় পরাঙ্গম, যা অন্যদের আয়ত্ব করতে বেশ বেগ পেতে হয়।

“প্লিজ কিছু বলুন, আমাকে এই নিয়ে লিখতে হবে। আপনার শিল্পকর্ম নিয়ে কিছু অন্তত বলুন।” আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
“আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি লিখুন…এখন ঈদ সেল চলছে। ফাওয়াজ রবের সকল শিল্প কর্মে ২০% ছাড়। যোগাযোগে মিস্টার আজাদ, Tivoli গ্যালারি গুলশান ২।
“ওহ প্লিজ।”

“আপনি আমাকে কি বলতে বলেন? আপনি চাইছেন আমি সেই একই রেকর্ড আবার বাজাই। আমি কিভাবে আমার সময়কে ধরে রাখি, আমি বাংলাদেশি শিল্পকে কোন দৃষ্টিতে দেখি আর আমাদের এই শিল্প গুলোকে প্রচার করা উচিত কি না? আপনি কি জানতে চান? আমার সংগ্রাম আর অধ্যবসায়ের গল্প? কি করে আমি সবকিছুকে পার করে নিজেকে এই সমসাময়িক শিল্পের জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছি? কিভাবে একজন ফরাসি সমলোচক আমার শিল্পকে অনুধাবন করেন এবং তা নিয়ে একটা ফরাসি ম্যাগাজিনে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন? এই গল্পগুলো হাজারবার বলা হয়ে গেছে এবং এগুলো তার গুরুত্ব আজ থেকে আরো তিন দশক আগেই হারিয়েছে। একজন আবেগপ্রবণ নতুন শিল্পীর সংগ্রামের গল্প, তিনি কি করে তার সময়কে ধরে রাখেন তা বিশ্বের তাবড় তাবড় ম্যাগাজিনে অনেকবারই প্রকাশিত হয়েছে। এই গল্পগুলো স্রেফ জঞ্জাল আর এই গুলোকে আমি আর কখনোই বলতে চাই না। এর জন্যই আমজনতা উচ্চমার্গীয় শিল্প (high art) কে পাত্তা দেয় না। যার ফলে এর মূল্যায়ন শেষে গিয়ে ঠেকে সমাজের ক্ষুদ্র উঁচু শ্রেণীর কিছু মানুষের কাছে। যা চূড়ান্ত রকমের হাস্যকর।”
“আপনি বিমূর্ত শিল্প নিয়ে কেন কাজ করেন না?”
“আমি অবশ্যই এটা নিয়ে কাজ করতে চাই। কিন্তু তার আগে ব্যপার টা বুঝতে হবেতো”। (হাসি)
“আপনি বিমূর্ত শিল্পীদের বিপরীতে কিছু বলতে চান?
“না। আমি কেন বলবো? সব কিছুই বিমূর্ত। আমার ছয় বছরের মেয়ে ক্রেয়ন দিয়ে নিজের মতো আঁকাআঁকি করে। সেটাও একরকম ভাবে বিমূর্ত। আমি আমার মেয়ের বিরুদ্ধে কি করে কথা বলি?” (হাসি)

“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন তাহলে আমাকে সাহায্য করুন। আপনার নিজের গল্প আপনার নিজের ভাষা ভঙ্গিতেই বলুন।”
“এখানে বলার মতো তেমন কিছু নেই। আমি শিল্প নির্মাণ করি আমার নিজের তাগিদে। আমি আমার শিল্প নির্মাণ কাউকে প্রভাবিত করার জন্য করি না। বিশেষত শিল্পের ইতিহাস নিয়ে যারা কাজ করেন, শিল্পাচার্য, এবং শিল্পবোদ্ধাদের তো কদাপি নয়। আমি এগুলো করি… কারণ এগুলো সুন্দর। একটা সিনেমা আছে নাম “la grande beleza”। অসম্ভব সুন্দর। আমার এই নামটি বিশেষ পছন্দের। শিল্প নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জড়িত সব কিছু হলো la grande beleza। আমার মা ছবি আঁকতেন। তার আঁকা দেখাটা ছিলো এক অনিন্দ্যসুন্দর অভিজ্ঞতা। আমি আঁকি কারণ আঁকাআঁকি এই পাগলাটে নির্মম পৃথিবীর অসমতা ও অমানবিকতা থেকে আমাকে দূরে রাখে। আমি যখন বলছি তখন এটা আপনাকে মানতেই হবে… আমার কাজের মাঝে যদি কোনটি হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে যায় বা হারিয়েও যায় আমার তাতে কিছুই আসবে যাবে না। সময়…। ঈশ্বরের সবচেয়ে কঠিন প্রতিশোধ হলো সময়। শুধুমাত্র সময় ই বলতে পারে একটি শিল্পের সাথে কি ঘটবে। আর এটাই হলো সবচেয়ে বড় অসহায়ত্ব। আজ থেকে ১০০ বছর পর জানা যাবে এই সাক্ষাতকারের আদৌ কোন মূল্য আছে কি নেই, যখন আমি বা আপনি দুজনেই মরে যাবো এবং এখানে আমাদের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। আমি শিল্প নির্মাণ করি কারণ এই একটা কাজই আমি জানি যা আমি কোন চিন্তা না করেই করতে পারি।”

“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
“আপনাকেও ধন্যবাদ। ২০% ছাড়ের কথাটা আবার ভুলে যাবেন না যেন।”
আমরা হেসে বিদায় নিলাম। ফাওয়াজ রব একজন হঠাৎ হয়ে যাওয়া শিল্পী যিনি পূর্ণ সততার সাথে তার নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন। তার গায়ে লেগে থাকা শিল্পীর সম্মান এবং গর্বকে তিনি মুহূর্তেই ছুড়ে ফেলতে পারে। তিনি আসলেই কোন কিছুকে পাত্তা দেন না। এখন, বোধ হয় আমি আরো ভালোভাবে তার শিল্পকে অনুধাবন করতে পারছি।