করোনাভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারের কারণে দেশে দেশে সরকারিভাবে লকডাউন ও কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আমরা যখন গৃহবন্দি হয়ে পড়লাম তখন ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগ একটি নতুন মাত্রা পেয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মাঠপ্রশাসনের সঙ্গে মিটিং করে যাবতীয় আদেশ-নির্দেশ দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন ভিডিও কলের মাধ্যমে। এই ঘরবন্দিকালে অনেক অফিস ও কোম্পানিই কর্মীদের ঘরে থেকে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে ভার্চুয়াল অফিসের কাজ ও অন্যদিকে নিছক বিনোদনের জন্য হলেও ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অনলাইনে লেখাপড়ার কাজটিকেও এগিয়ে নিচ্ছে। আবার ফেসবুক, টুইটারে মানুষের সংযুক্ত থাকার হার বেড়েই চলেছে। অনলাইনে রান্নার অনুষ্ঠান দেখা, মানসিক স্বাস্থ্য ও যোগাসনের অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের হার বেড়ে গেছে। চাপ পড়ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম, টেলিকনফারেন্সিং ও ভিডিওস্ট্রিমিংয়ের ওয়েবসাইটগুলোতে। ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো ভিডিও কনটেন্টের ওয়েবসাইটেও ক্লিক বাড়ছে।
এ সময় মানুষ ব্যাংকে যেতে না পারলেও অনলাইন ব্যাংকিং, এটিএম কার্ড, আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুযোগ গ্রহণ করে অর্থ লেনদেন করছে। অনলাইনে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে। বেচা-কেনার এক নতুন মাধ্যম হয়ে উঠেছে বিভিন্ন অ্যাপ ও ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন শপিং। এখন আর ভোক্তাকে বাজারে গিয়ে পছন্দের জিনিস কিনতে হচ্ছে না। ইন্টারনেটে জিনিস পছন্দ করে অর্ডার দিলেই তা বাসায় পৌঁছে যাচ্ছে। মূল্য পরিশোধ করে ভোক্তা তা গ্রহণ করতেও পারছে।
করোনাকালে মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনেক মানুষই স্তব্ধ হওয়া জীবনকে গতিশীল রাখার চেষ্টা করছে। জীবনের প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন কাজগুলোকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। যে মোবাইল-ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষ জীবন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সচল রেখে জীবন-প্রবাহকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে, বিস্ময়করভাবে সেই মোবাইল-ইন্টারনেটের উপরই সরকারিভাবে ব্যয়বৃদ্ধির খাঁড়া নেমে এসেছে। নতুন ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের মাধ্যমে সেবার বিপরীতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এতে মোবাইল ফোনে কথা বলা, এসএমএস পাঠানো এবং ডেটা ব্যবহারের খরচও বেড়ে যাবে। নতুন এই শুল্ক-প্রস্তাব কার্যকর করা হলে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সেবায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও এক শতাংশ সারচার্জ, ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং অন্যান্য মিলে মোট কর ২৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশে। এর ফলে মোবাইল ব্যবহারকারীদের ফোনে কথা বলার খরচ তো বাড়বেই, মোবাইল ইন্টারনেটের খরচও বাড়বে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত এমন সময় এলো, যখন প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষের স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত এবং ঘরে থেকে বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানো ও সময় কাটানোর জন্য ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বিটিআরসির সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৬ কোটি ৬১ লাখ সেলফোন সংযোগের মধ্যে, ইন্টারনেট সেবার আওতায় রয়েছে প্রায় ১০ কোটি। যার প্রায় সাড়ে ৯ কোটিই সেলফোন অপারেটরদের ইন্টারনেট সেবায় যুক্ত। এ তালিকায় শীর্ষ ধনীরা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন দরিদ্র মানুষও।
সরকার মানুষকে ঘরে থেকে অনলাইনে সবকিছু করতে উৎসাহিত করছে৷ অথচ ঘরে থেকে কাজ ও যোগাযোগ চালানোর প্রধান মাধ্যম ইন্টারনেটের উপর শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এটা অত্যন্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত দ্রুত গতিতে বিকাশ হওয়া অনলাইন মার্কেটের গতি শ্লথ করে দিতে পারে। ক্রমেই দীর্ঘায়িত হওয়া করোনাকালে শিক্ষার্থীদের অনলাইন লেখাপড়ার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। একথা ঠিক যে, আর্থিক দুর্দিনে সরকারের রাজস্বের দরকার আছে৷ করোনাকালে অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান করতে হবে৷ কিন্তু হুট করেই মোবাইল ব্যবহারে উপর শুল্ক বাড়াতে হবে কেন? এমনিতেই আগামী দিনগুলোতে গরিব ও মধ্যবিত্তদের টানাটানি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাড়তি ব্যয়ের সংস্থান করতে না পারায় গ্রাহকরা যদি এর ব্যবহার কমিয়ে দেয় তাহলে তো রাজস্ব উল্টে কমে যেতে পারে৷ আর সরকার যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলছে, তখন ইন্টারনেটের উপর অতিরিক্ত শুল্ক কেন? শুধু বড় অফিস নয়, ছোট-খাট অফিসগুলোও ইন্টারনেটের উপর ভিত্তি করে কার্যক্রম চালাচ্ছে৷ এই বাড়তি শুল্ক তাদের অপারেশন খরচও বাড়িয়ে দেবে।
করোনায় ঘরবন্দি মানুষের সামাজিক কিংবা ব্যক্তিগত যোগাযোগে ভরসা এখন মোবাইল আর ইন্টারনেট। এই সেবা কতটা সস্তা এবং মানসম্মত করা যায়, সেই চেষ্টা থাকা দরকার। কিন্তু সেই চেষ্টা না করে উল্টো দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিলে তা হবে বোঝার উপর শাকের আঁটি।
এমনিতেই মোবাইল সেবার মান নিয়ে গ্রাহকদের অনেক অভিযোগ ও হতাশা আছে। ভয়েস কলে মিলছে না গুণগত সেবা। করোনার এ সময়ে, ইন্টারনেটের চাহিদা বাড়লেও, বাড়েনি সেবারমান। হংকংভিত্তিক আন্তর্জাতিক মোবাইল সেবাবিষয়ক বিশ্লেষণী সংগঠন ওপেনসিগন্যাল-এর এক পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে মোবাইলে ইন্টারনেটের গতি কমে গেছে। ৪২টি দেশের ওপর চালানো পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশেই ডাউনলোডের গতি সবচেয়ে কম। এ পরিস্থিতিতে ইন্টারনেটের গতি বাড়ানোর দিকে বরং সরকারকে অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার।
পৃথিবীর অনেক দেশেই লকডাউনে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে মানুষকে ফ্রি ইন্টারনেট সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশে সরকার ঠিক বিপরীত ভূমিকা পালন করছে। যা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। করোনা কিন্তু ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে, চাল-ডাল-দুধ-ঔষধের মতো ইন্টারনেটও প্রকৃত অর্থে জরুরি পরিষেবা। ইন্টারনেট আছে বলে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য ও নির্দেশিকা দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে, ঘরে বসেই ব্যাংকিং ও অন্যান্য পরিষেবা মিলছে, বিকাশের মাধ্যমে কোটি কোটি মানুষ টাকা লেনদেন হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম পরিশোধ করা হচ্ছে। বহু শিক্ষার্থী অনলাইনে পড়াশোনাও করছে।
করোনাভাইরাসের এ সময়ে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার বিশ্বের প্রচলিত অনেক ধারণাই পাল্টে দিচ্ছে। এমনকি এটি বদলে দিতে পারে ভবিষ্যত কাজের ধরনও। ঢাকা শহরে স্বাভাবিক সময়ে রাস্তার যে ভোগান্তি; যানজট ঠেলে আগে যেমন মানুষ অফিসে যেত, এখন অনলাইনে সেটি করছে। অবস্থা স্বাভাবিক হলেও অনলাইন অফিসের চর্চা থেকে যেতে পারে। অথচ নিম্নবিত্ত, গ্রামবাসী, কৃষক-শ্রমিকের কাছে এখনও এটা প্রায় অধরা।
ইন্টারনেটকে বিদ্যুৎ পরিষেবার মতো অত্যাবশ্যক হিসাবে গণ্য করা এই মুহূর্তে সরকারের কর্তব্য হওয়া উচিত। এই পরিষেবার সঙ্গে মোবাইল ফোন নির্মাতা, ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী সংস্থা থেকে শুরু করে একটি বিরাট বাজার জড়িত এবং বাংলাদেশে ইন্টারনেট পরিষেবা এই মুহূর্তে প্রধানত বাজার-পরিচালিত। করোনামহামারির জরুরি অবস্থায় ইন্টারনেটের অপরিহার্যতা বুঝিয়ে দিয়েছে, একে আর কেবল বাজারের লাভ-লোকসান দিয়ে ভাবলে চলবে না। সরকারকে অবিলম্বে নিম্নবিত্ত ও সঙ্গতিহীনের কাছে ইন্টারনেট পৌঁছাবার ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। পারলে মোবাইল ফোনও সরবরাহ করতে হবে। কেননা অনেক পরিবারের জন্য মোবাইল ও তদুপরি ইন্টারনেট সংযোগ বিপুল খরচের ব্যাপার। অথচ শিক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় যোগাযোগের জন্য এখন প্রতিটি পরিবারেই স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ অপরিহার্য। আপৎকালীন অবস্থায় আপাতত ভাবা যেতে পারে প্রতিটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড স্তরে ‘ইন্টারনেট হাব’-এর কথা। সেখানে কম্পিউটার, স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে, অবশ্যই থাকবেন পরিষেবা সহায়ক কর্মী। ইউনিয়ন পর্যায়ে সরকারি ‘তথ্য-সেবাকেন্দ্র’গুলো এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। সেগুলোকে কার্যকর করার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে না দিয়ে এই বন্দোবস্ত এখনই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ ২০১৬ সালে ইন্টারনেটকে মানবাধিকার হিসাবে ঘোষণা করেছে। অনেক দেশই প্রত্যেক ঘরে ইন্টারনেট এবং প্রতিটি দরিদ্র পরিবারে বিনামূল্যে ট্যাব বা মোবাইল ফোন প্রদানের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। করোনা কবে যাবে, তা কেউ বলতে পারছে না। আর করোনা বিদায় নিলেও বিশ্ব তথা বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির বিন্যাসে যে অভূতপূর্ব বদল আনবে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতেও ইন্টারনেটের বিকল্প নাই। আর্থ-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ সস্তায় এই পরিষেবা পেলে দেশেরই মঙ্গল।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)