মুসলমানের ধর্মীয় উৎসব ঈদে প্রিন্স বাজার যদি শুকরের মাংসে বিশেষ ছাড় দেয় এবং এটা প্রচারে ঈদ মোবারক লিখে নীচে শুকরের মাংসের ছবি প্রকাশ করে, তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানের সেটা ভালো লাগবে তো? না লাগবে না। লাগার কোন কারণই নেই। কারণ এরকম একটা ছবি শুধু অসংবেদনশীলই নয়, সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলকও। এরকম একটা ছবির জন্য দেশে যে শুধু মিছিল, প্রতিবাদ হবে তাই নয়, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যেতে পারে।
তার বিপরীতে গতকাল প্রিন্স বাজার যখন শারদীয় উৎসবে ক্রেতাদের জন্য বিশেষ ছাড় হিসেবে গরুর মাংসের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলো তখন আমরা অবাক হয়ে দেখলাম যে, অনেকেই প্রিন্স বাজারের পক্ষে সাফাই গাইতে দাঁড়িয়ে গেলেন। (কু) যুক্তি হিসেবে তারা সামনে নিয়ে এলেন ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’ স্লোগানটি। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম, অনেক শিক্ষিত, সংবেদনশীল মানুষেরাও এই স্লোগানের মর্মার্থ এবং প্রিন্স বাজারের অপরাধ বুঝতে অক্ষম!
বাঙালি সংখ্যাগুরুর এই ক্ষমতাটা বোঝা খুব কঠিন নয়। সবটাই সংখ্যাগুরুর মাইন্ডসেটের সমস্যা। এই মাইন্ডসেট এমনভাবে আমাদের মাঝে গেঁথে থাকে যে, আমরা টেরই পাইনা কীভাবে, কখন আমরা এই মানসিকতা দ্বারা অন্যকে আঘাত করে বসি। আমরা ভুলে যাই ‘উৎসব সবার’ মানে অন্যের ধর্মের মূল বা প্রধান আচরণবিধি বা নিয়ম নিয়ে ব্যবসা বা মশকরা করা নয়।
বাংলাদেশের এইসব বিভ্রান্ত সংখ্যাগুরুরা কখনও ভেবে দেখেছেন কি, উৎসব তো দূরের কথা, সাধারণভাবেও প্রিন্স বাজার বা এই ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কখনও শুকরের মাংস বিক্রি করতে পারবে কী না? কোন বিশেষ অফার টফারের বালাই ছাড়াই অন্য যেকোন পণ্যের মতো শুকরের মাংসও কেন তারা রাখেন না? কারণটা বুঝতে রকেট সাইন্স জানার প্রয়োজন পড়ে না। অন্য যেকোন পণ্যের মতো শুকরের মাংসও দোকানে রাখলে তাদের আর বাংলাদেশে ব্যবসা করে খেতে হবে না। যারা বলার চেষ্টা করছেন যে প্রিন্স বাজার না বুঝে এই ভুলটা করেছে তাদের কাছে প্রশ্ন রইলো, প্রিন্স বাজার না বুঝে উল্টা ভুলটা কেন করে না বা করবে না কখনো? উল্টো ভুলটা যে মারাত্মক বিপদজনক সেটা তারা কি করে বুঝতে পারে?
সবশেষে, আরেকটা কুযুক্তির উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো। অনেকে খ্রিস্টমাসের সময় মদের বিশেষ অফার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন, তখনতো মুসলমানরা অনুভূতিতে আঘাত লাগলো বলে তেড়ে আসে না। সত্যি? আপনারা এটা ভেবে বলছেন তো? না, আপনারা যথেষ্ট ভাবেননি। আসলে ভাবার প্রয়োজনই মনে করেননি। আপনাদের সংখ্যাগুরু মন এর বাস্তব চিত্র ভাবতে বলেনি। শুধু পাল্টা কিছু একটা উদাহরণ দাঁড় করাতে চেয়েছে।
বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে মদ অস্পৃশ্য নাকি শুকরের মাংসের মত? অথবা হিন্দুর কাছে গরুর মাংসের মতো? বাংলাদেশের অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসলমান আছে যাদের বিশেষ উৎসব মানেই মদ পান। ধর্ম নির্বিশেষে এমন মানুষ পাওয়া কঠিন হবে যারা জীবনে একবারের জন্য হলেও মদ চেখে দেখেননি। গরু বা শুকরের মাংসের ব্যাপারে কি বাস্তবতাটা একইরকম? অসংখ্য বাঙালি মুসলমান মদকে কখনোই অস্পৃশ্য মনে করেন না। ধর্মের এই নিষেধাজ্ঞা মানার ক্ষেত্রে তাদের তেমন গা ব্যথা দেখিনি কখনো। বরং উল্টোটার চলই প্রকট। দুঃখজনক সত্যিটা হলো, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার কথা আমরা কেবল মুখেই বলি, অন্তরে ধারণ করি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)