‘কুড়িটা মানুষের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে। তারা চা-কফি খাচ্ছে। বাবুর্চিকে বলছে, টমেটো-মাংস রান্না করো। আমরা রাতের খাবার খাব। কতোটা অমানুষ মানুষ হলে তারা এটা করতে পারে। পশুর সঙ্গেও এদের তুলনা চলে না। ইতালির নাগরিক গর্ভবতী নারী ছিল সেখানে। তারা তাকেও অব্যাহতি দেয়নি। কী অপরাধ ছিল ওই মায়ের, ওই পেটের শিশুর? ইসলামের নামে যারা হলি আর্টিজানের মতো হামলার ঘটনা ঘটায় তারা মানুষ নয় ‘অমানুষ’।’
আন্তর্জাতিক সুফি উৎসবের উদ্বোধনীতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমনটি বলেছেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। ভারত, ইরান ও তুরস্কের রাষ্ট্রদূতের উপস্থিতিতে শুক্রবার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয়েছে তিনদিনের আন্তর্জাতিক সুফি উৎসব। শিল্পকলার নন্দন মঞ্চে আল্লামা রুমি ফাউন্ডেশন ও হাটখোলা ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এই উৎসবের আয়োজন করেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সংস্কৃতিমন্ত্রী বলেন, ‘অশুভ শক্তিকে দমাতে সুফিবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সুফি উৎসবে একটা বোধের তৈরি হবে- আমরা একে অন্যের পাশে দাঁড়াব।’ সুফিবাদে মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রকাশ ঘটে উল্লেখ করে সংস্কৃতিমন্ত্রী নূর বলেন, “সব ধর্মকে সম্মান দেওয়ার, সব ধর্মকে সহাবস্থান দেওয়ার মতো গ্রহণযোগ্যতা তৈরির বাণী প্রচার করে এটি।”
হাজার বছর ধরে সব ধর্মের বাঙালিরা সুফিবাদের মতো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিয়ে বসবাস করে আসছে মন্তব্য করে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর আরো বলেন, ‘এ অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষের পাশাপাশি রয়েছে নানান ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ। যারা হাজার বছর ধরে বাস করছে সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে। লালন, রাধারমন, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম- সবার মধ্যে সেই মানবতাবাদী চিন্তাই ছিল।’
ইসলামের মর্মবাণীও শান্তির কথা বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আল্লাহ কোরআন শরীফের কোথাও বলেননি, আমি মুসলমানদের প্রভু। বলেছেন, আমি বিশ্ব মানবতার প্রভু, আমি বিশ্বাসীদের প্রভু।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকায় ইরানের রাষ্ট্রদূত আব্বাস ভায়েজি দেহনবি বলেন, ‘ধর্মীয় মর্মবাণীর চর্চা প্রত্যেক মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই বাণীর অপব্যাখ্যা যে কোন ধর্মের জন্যই ভয়ঙ্কর। তার ফলে সৃষ্টি হয় ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর। এর বিপরীতে সুফিবাদ শান্তির বারতা নিয়ে হাজির হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘প্রত্যেক ধর্মের মূল বাণীই হচ্ছে, তুমি যদি স্রষ্টাকে ভালোবাসো, তাহলে তোমাকে সব মানুষ ও প্রাণীকূলকে ভালোবাসতে হবে। সুফিবাদ সেই ভালোবাসার বাণীকে ছড়ানোর কাজ করে।’
ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় ইরানের অন্যতম বিরোধী তুরস্ক। কিন্তু সুফি উৎসব মিলিয়েছে ইরান-তুরস্ককে। বাংলাদেশে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত ডেভরিম ওজতুর্ক বলেন, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম। সেই শান্তির সবচেয়ে উন্নততর ব্যাখ্যা হচ্ছে সুফিবাদ। সুফিবাদের চর্চা বিশ্বব্যাপী ইসলামের নামে সংঘাতের পথ বন্ধ করতে পারে।”
আল্লামা রুমি ফাউন্ডেশনের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবদুল করিম বলেন, ‘বাংলাদেশের ৮৫ ভাগ মানুষ মুসলিম হলেও তারা হাজার বছর ধরে অসাম্প্রদায়িক চেতনাতে বেড়ে উঠেছে। তারা হিজাব পড়লেও ভোটের সময় দুইজন নারীকেই বেছে নেয়। উদার মুসলিম বাংলাদেশে যারা সন্ত্রাস ও উগ্রবাদের চর্চা করে তাদের সংখ্যা নগণ্য এবং তারা সমাজ বিচ্ছিন্ন।’
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘সুফিবাদের সার কথা হল ভালোকে গ্রহণ করা ও মন্দকে পরিহার করা। লালন ফকিরের মতো সাধকরা সেই মর্মবাণীকে গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে।”
সংস্কৃতি সচিব ইব্রাহীম হোসেন খানের অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উৎসব আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ইউসুফ মোহাম্মদ বক্তব্য দেন।
আয়োজকরা জানান, তিনদিনের এই আয়োজনে ১১৯জন সুফি গানের শিল্পী এবং বিদেশি পাঁচটি ব্যান্ড গান পরিবেশন করবে।
উদ্বোধনের পর সন্ধ্যায় মাইজভাণ্ডারী মরমী গোষ্ঠীর পাশাপাশি শিল্পী সফি মণ্ডল, সমির কাওয়াল, রাফাত ও পারভেজ সুফি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। প্রথম দিনের শেষভাগে সুফি গান পরিবেশন করে ভারতীয় দল ‘সুফি বাওড়া’।
উৎসবের তিনি দিন শিল্পকলার বিভিন্ন মিলনাতয়নে সেমিনারসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকছে। পাশাপাশি বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত নন্দন মঞ্চে চলবে সঙ্গীত পরিবেশনা।