শিরোনাম দেখে অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন করোনার মতো একটি অতিমারিতে যখন সারাবিশ্ব নাকাল, তখন এটি কেমন শিরোনাম! একজন করোনা পজিটিভ হিসেবে বলছি, করোনার প্রায় সবগুলো উপসর্গ আমি মোকাবিলা করেছি মহল্লার ফার্মেসির মাধ্যমে।
শুরুতে আক্রান্তের তালিকার অনেক পেছনে থাকলেও ৯০তম দিনে (৫ জুন) এসে করোনাভাইরাস সংক্রমিত শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় ঢুকে গেছে বাংলাদেশ। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে কিছুদিনের মধ্যে হাসপাতালগুলোয় রোগীদের জায়গা দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের নাজুক স্বাস্থ্য খাত অধিকতর সংকটে পড়বে। কোথাও কোথাও হয়তো মানবিক সংকটও দেখা দেবে। এই যখন অবস্থা, তখন করোনাকে মহল্লার ফার্মেসিতে নামিয়ে আনাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ১৭ দিন পর ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি (লকডাউন)। এরপর সাত দফায় ছুটি বাড়ানো হয়, যা শেষ হয় ৩০ মে। সাধারণ ছুটি শেষে রাস্তায় জনস্রোত। এরমধ্যে সাধারণ ছুটির শুরুতে, গার্মেন্টস খোলা ও ঈদের আগে পরে রাজধানী থেকে বের হওয়া এবং ঢুকতেও জনস্রোতের খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। সেই চিত্র দেখে মনে হয়েছিলো, শিগগিরই হয়তো করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক লাখে পৌঁছে যাবে।
তা হয়নি, কিন্তু শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। যত বেশি পরীক্ষা করা হবে, শনাক্তও তত বাড়বে। এটা আরও কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা এখনই বলা কঠিন। তাহলে করণীয় কী?
বৃহস্পতিবার (৪ জুন) পরিচিত একজন রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে করোনার নমুনা দিতে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। সিরিয়াল নম্বর ১২৩৮। এই টোকেন নিতে আর লাইন ঠিক রাখতে ৫০০ টাকা এক দালালকেও দিয়েছেন। বিকাল নাগাদ লাইন ধরে যখন আর মাত্র ২০/২৫ জন বাকি, ঠিক তখনি ঘোষণা এলো কিট শেষ হয়ে যাওয়ায় আজ আর পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। করোনা উপসর্গ নিয়ে অসুস্থ শরীরে সারাদিন লাইন ধরে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে বলেছেন, পরদিন ফজরের নামাজ শেষে আবারও লাইনে দাঁড়াবেন।
দৃষ্টি দেয়া যাক বেসরকারি হাসপাতালে। একজন হার্টের রোগী হাসপাতালে গেলে তাকে বলা হয়, করোনা পরীক্ষা করে আসতে হবে, না হলে ভর্তি নেয়া হবে না। জরুরিভিত্তিতে অন্য এক বেসরকারি হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করে একদিনে রিপোর্ট আনতে গেলেন। কিন্তু শর্ত, দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। করোনাকালে চিকিৎসা না দেয়া, করোনা টেস্টের সঙ্গে ডেঙ্গু টেস্টে বাধ্য করা কিংবা রোগী আটকে ভুতুড়ে বিল আদায়সহ নানা ঘটনা এরইমধ্যে গণমাধ্যমে এসেছে।
চিকিৎসা সেবার এমন গোলকধাঁধার দেশে মহামারি করোনা সেই আতঙ্ক বাড়িয়েছে মারাত্মক আকারে। রাস্তায় ভুলেও কেউ হাঁচি কাশি দিলেও রক্ষা নেই। জ্বর, কাশি, গলাব্যথা পাত্তা না দেয়া অনেকেই সামাজিক হেনস্থা বা লকডাউনের ভয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে ওষুধ কিনছেন, এমন খবরও অজানা নয়। করোনা হোক বা না হোক, সামান্য জ্বর, কাশিও এখন ক্যান্সারের মতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
করোনায় মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা যখন বাড়ছে, তখনই প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন মানুষের রুটিরুজির স্বার্থে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। যদিও অনেকে এর সমালোচনাও করেছেন। প্রশ্ন এসেছে কোনটি আগে, জীবন না কি জীবিকা? উত্তর অনেকটা এরকম, ‘বেঁচে থাকলে খেতে হবে। আবার খেতে হলে বাঁচতে হবে।’ অর্থাৎ খেতেও হবে আবার বাঁচতেও হবে। সরকারের সিদ্ধান্তে বোঝা যাচ্ছে হার্ড ইমিউনিটির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ মানুষের নিজের যুদ্ধ এবার অনেকটা নিজেকেই করতে হবে।
ধারণা করা হয়, সংক্রমণের এমন সিস্টেমে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ লোক আক্রান্ত হবে। সংখ্যার হিসাবে দাঁড়ায় অন্তত ১০ কোটি। অর্থাৎ প্রায় ঘরে ঘরে হানা দেবে করোনা। এরমধ্যে ৮০ শতাংশ লোক আতঙ্কিত না হয়ে নিজেরা সাধারণ চিকিৎসা নিতে পারলে সুস্থ হয়ে যাবেন। বাকি ২০ শতাংশের মধ্যে মডারেটলি, সিভিয়ারলি ও ক্রিটিক্যালি—তিন ধরনের রোগী থাকবেন। এরমধ্যে বেশি শ্বাসকষ্ট, করোনার বাইরে অন্য রোগের উপদ্রব, বেশি বয়স্ক এমন ৫ শতাংশের মতো অর্থাৎ প্রায় ৫০ লাখ ক্রিটিক্যাল করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য ভেন্টিলেশন, অক্সিজেন বা হাসপাতালের বড় সাপোর্ট লাগবে। প্রশ্ন হলো সেই সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কি না। আবার সময়ের সাথে অনেকটা ব্যবস্থা করা গেলেও মানুষ চিকিৎসা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কি না?
ফিরে আসি শিরোনাম প্রসঙ্গে। করোনা যে ঘরে ঘরে হানা দেবে, এরইমধ্যে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ জানে না এ অবস্থায় তারা কী করবে? সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে যখন চিকিৎসা অপ্রতুল এবং নানারকম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনাও যখন স্বাস্থ্য খাতের পুরনো রোগ—তখন করোনা যদি সত্যিই ঘরে ঘরে হানা দেয়, তখন পরিস্থিতি কোথায় দিয়ে দাঁড়াবে? এখনই কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোয় বেড খালি নেই, আইসিইউ সোনার হরিণ। ফলে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠী হাসপাতালের বারান্দায় ঢুকতে পারবে না—তাতে করোনা চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের সংখ্যা যতই বাড়ানো হোক, এমনকি দেশের সব হাসপাতালেও যদি করোনার চিকিৎসা হয়।
মনে রাখা দরকার, এখনও সাধারণ জ্বর সর্দি কাশিতে মানুষের প্রধান ভরসা তার বাসার কাছে মহল্লার ফার্মেসি। করোনা যেহেতু একটি ফ্লুজনিত রোগ, অতএব শরীরে বড় ধরনের জটিলতা না থাকলে এর প্রাথমিক চিকিৎসা প্যারাসিটামলের মতো সাধারণ ওষুধ আর গরম পানি। সেক্ষেত্রে যদি করোনা ঘরে ঘরে হানা দেয়ও, তখনও আতঙ্কিত না হয়ে এই রোগকে সাধারণ রোগের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। অর্থাৎ করোনা কাউকে আক্রমণ করলেও তাকে মহল্লার ফার্মেসি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে।
এজন্য বাড়াতে হবে করোনা পরীক্ষার পরিমাণ। সেক্ষেত্রে পিসিআর টেস্টের পাশাপাশি সময় এসেছে র্যাপিড টেস্টেরও। সারা দেশের ২৫ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ফার্মেসির লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এই কাজটি শুরু করা যায়। এতে টেস্টের জন্য মানুষের হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা কমবে, হ্রাস পাবে আতঙ্ক। অল্প টাকায় অন্তত টেস্ট করে প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকে স্বস্তি পাবে বিশাল জনগোষ্ঠী।
একজন করোনা পজিটিভ হিসেবে বলছি, করোনার প্রায় সবগুলো উপসর্গ আমি মোকাবিলা করেছি সাধারণ কিছু ওষুধ গ্রহণ আর নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে। এখন সুস্থ বোধ করছি। বস্তুত শ্বাসকষ্ট ছাড়া করোনার সবগুলো উপসর্গ বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বছরে দুয়েকবার মোকাবেলা করেন। তখন মহল্লার ফার্মেসিতেই তাদের আস্থা রাখতে হয়। সুতরাং সরকারও চাইলে জনগণের জন্য কিছু নিয়ম কানুন ও উপসর্গ হিসেবে কোন ধরণের ওষুধ খাবে—বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে এর একটি গাইডলাইন প্রচার করতে পারে। এতে করোনা নিয়ে আতঙ্ক কমবে। খুব সহজে নিজেরা চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকতে পারবে।
সরকার মনিটরিং করবে করোনা টেস্ট, ওষুধের দাম ও ক্রিটিক্যাল রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়। এতে হাসপাতালমুখী মানুষের চাপও কমবে। অতি ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। সেখানে যাতে কোনো ধরনের বৈষম্য তৈরি না হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আতঙ্ক কমিয়ে চিকিৎসা নেয়ার পদ্ধতি সহজ করতে না পারলে লাখ লাখ মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করবে।
ঘরে ঘরে যদি করোনা হানা দেয় এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা যদি মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো না যায়, তাহলে ঘরে ঘরে মৃত্যু ঠেকানো যাবে না। তখন এক ভয়াবহ দৃশ্য আমাদের দেখতে হবে। সুতরাং করোনা যে ভয়াবহ কোনো রোগ নয় এবং প্রতিদিনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেই যে একে মোকাবেলা করা সম্ভব, সেই বার্তাটি খুব স্পষ্টভাবে দিতে হবে এবং খুব গুরুতর না হলে করোনার চিকিৎসাকে মহল্লার ফার্মেসি পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)