বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভালের একটি ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব’। গেল পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত উচ্চাঙ্গসংগীতের এই অনুষ্ঠানটি রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে হয়ে আসছে। নিরাপত্তার অজুহাত কিংবা অন্য কোনো কারণে একবারও থমকে যায়নি সংগীতের এই বৃহৎ উৎসবটি। উচ্চাঙ্গসংগীতের এই উৎসবটি মানুষের মনে এতোটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, প্রতি বছর এটার জন্য প্রতীক্ষায় থাকেন সবাই। বাংলার সংগীত সমঝদার হাজারো মানুষ প্রতি নভেম্বরে আয়োজিত এই উৎসবকে ঘিরে প্রস্তুত হয়ে থাকেন। কিন্তু এবার ঘটতে চলেছে তার ব্যতিক্রম! প্রতি বছর আর্মি স্টেডিয়ামে উৎসবটি হয়ে আসলেও এবার সরকারি অনুমতি না থাকায় শেষ পর্যন্ত বাতিলই ঘোষণা করা হল অনুষ্ঠানটি।
ভেন্যু সংকটের কারণে হচ্ছে না বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৭, রবিবার রাজধানীর গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলের বলরুমে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বেঙ্গল ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভাল-এর আয়োজক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু এমনটাই জানালেন। সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন ইমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং লুভা নাহিদ চৌধুরী।
আর্মি স্টেডিয়ামে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের অনুমতি দেয়নি সরকার। আর সে কারণেই সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করেও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল করতে হল জানিয়ে আবুল খায়ের লিটু সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের হয়তো আরো অনেক বড় পরিকল্পনা আছে। আর সে কারণেই হয়তো এবার উনারা আমাদের আর্মি স্টেডিয়ামটি বরাদ্দ দিতে পারেননি। আর এই কারণেই সবকিছু গুছিয়ে আনার পরেও আমরা উৎসবটি ক্যানসেল করতে বাধ্য হলাম।
আমরা যে সময় উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎসবটি করবো সেসময় হয়তো এখানে সরকারের আরো বড় কোনো প্ল্যান আছে। উৎসবটি হচ্ছে না বলে সেজন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি। এই কষ্টটা এমন কষ্ট যা শেয়ার করতে আমার খারাপ লাগবে না, হয়তো একটু বেশী ইমোশনাল হয়ে যাবো। এভাবেই বলছিলেন আবুল খায়ের। এরপর মঞ্চের ডায়াজে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকেন। এরপর আবার বলতে শুরু করেন উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবটির বাতিল হওয়া নিয়ে। এই উৎসবটির সঙ্গে তার যে ইমোশন জড়িত তা কোনো অংশে নিজের ছেলে হারানোর শোকের চেয়ে কম নয় বলেও জানান এই সংগঠক।
বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক নিয়ে শুরুতে অনেকের মনে অনিশ্চয়তাও ছিল। কিন্তু সব পাশ কাটিয়ে দৃঢ় মনোবলে বাংলাদেশে এমন একটি উৎসব সফলভাবে করতে পারার পেছনের কারণও উল্লেখ করেন আবুল খায়ের। শুরুর কথা জানিয়ে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আরো জানান, প্রথমে যখন বাংলাদেশে আমরা শাস্ত্রীয় সংগীতের এই অনুষ্ঠানটি শুরু করি, তখন অনেকেই ভুরু ভাজ করেছেন। এরকমও বলেছেন, বাংলাদেশে উচ্চাঙ্গসংগীত শোনার মানুষ নেই। এখনকার তরুণরা বরং বিদেশি রকসংগীতে অভ্যস্ত, বা বেশী হলে দেশীয় ফোক শুনতে পারে। কিন্তু তখন আমাকে উৎসাহ যুগিয়েছেন মতিউর রহমান, মাহফুজ আনামের মতো মানুষরা। তাদের উৎসাহেই আমি প্রথমবার আয়োজনটা করি। বাংলাদেশের তরুণদের সম্পর্কে যে অনেকেই ভুল অনুমান করেন, সেটা শাস্ত্রীয়সংগীতে তাদের উপস্থিতি দিয়েই প্রমান করেছেন। গেল আসরেতো প্রতিদিন পঞ্চাশ, ষাট হাজার মানুষের যাতায়াত ছিলো এই সংগীত উৎসবে।
এটা স্রেফ সংগীত উৎসব হিসেবে নেইনি আমরা, আমরা মনে করেছিলাম শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের মধ্য দিয়ে মানুষের মনন ও রুচিতেও এক ধরনের পরিবর্তন আনা সম্ভব। আমরা মনে করি, আমরা ঠিক পথেই ছিলাম। বিগত পাঁচটি আসর নিয়ে দেশজুড়ে সংগীত পিপাসু মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক আগ্রহ দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, আমরা সফল। এভাবে বিগত উৎসবগুলোর স্মৃতিচারণ করেন আবুল খায়ের।
তবে বিগত পাঁচটি আসর সম্পন্ন করতে বাংলাদেশ সরকার যে সহায়তা করেছে তা স্মরণ করেও সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান আবুল খায়ের। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত গ্রেটফুল যে বিগত পাঁচটি বছর অত্যন্ত সুন্দরভাবে সরকার আমাদের বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎসবটি করতে সহায়তা করেছেন। আমাদের সিকিউরিটির সমস্ত ব্যবস্থা তারা করেছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে মাঠটি আছে সেটি আমাদের বরাদ্দ দিয়েছিলেন।
আমার শুধু সরকারের কাছে একটাই অনুরোধ, এবার যেকোনো কারণেই হোক না কেন উৎসবটি ক্যানসেল হল। কিন্তু এই উচ্চাঙ্গসংগীতের উৎসবটি যে ধারা এই দেশে চালু করেছে তা যেনো এদেশ থেকে হারিয়ে না যায়। যেকোনো প্রকারেই হোক না কেন, এই উচ্চাঙ্গসংগীত যেনো চালু রাখা হয়।
এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি অনুরোধ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি অনুরোধ করবো, তিনি যেনো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে ইনস্ট্রাকশন দেন উনারা যেন আমাদের বদলে এই ফেস্টিভালটা বাংলাদেশে চালু রাখেন। কারণ এই উৎসবের ধারাবাহিকতা একবার হারিয়ে ফেললে বিদেশি শিল্পীদের কাছে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা যেমন হারাবে, আবার আমাদের দেশের শ্রোতা দর্শক এবং গানের পিপাসুরাও এমন সংগীত উৎসব থেকে বঞ্চিত হবেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন নাই বা থাকলো, কিন্তু কোনো সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন হলে আমরা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন তা করবো।
ছবি: জাকির সবুজ