ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনতে ২০১৮ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তারা আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমিয়ে নেয়াসহ একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু এক অংকের সুদহার বাস্তবায়ন করেনি।
এমতাবস্থায় সুদ হার এক অংকে আনতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে আজ রোববারই একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিভাবে সুদ কমানো যায় সেই কৌশল সম্পর্কে এই কমিটি আগামী ৭ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানালে সেই অনুযায়ী ১ জানুয়ারি সুদহার হ্রাস এবং খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু হবে বলে জানান তিনি।
রোববার রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে এনইসি সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যাংক মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সাথে বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান তিনি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে দিনদিন বেকারত্ব বাড়ছে। এই বেকারত্ব কমাতে হলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই। আর উৎপাদনশীল খাতকে বাঁচাতে ব্যাংক ঋণের সুদ হার এক অংকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখনো পর্যন্ত সুদহার এক অংকে নেমে আসেনি কেন এবং খেলাপি ঋণ দিন দিন কী কারণে বাড়ছে সেটা তদারকির জন্য একজন ডেপুটি গভর্নরকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটি কিভাবে সুদ হার কমানো যায় সেই কৌশল সম্পর্কে আগামী ৭ দিনের মধ্যে জানাবে। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে এই সুদ হার বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু হবে।
গত ১৬ মে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়, ঋণ খেলাপিরা মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়েই ঋণ পুন:তফসিল করতে পারবেন। পুন:তফসিল হওয়া ঋণ পরিশোধে তারা সময় পাবেন টানা ১০ বছর। এক্ষেত্রে প্রথম এক বছর কোনো কিস্তি দিতে হবে না। দেশে ঋণ খেলাপির সংখ্যা ১ লাখ ৭০ হাজার ৩৯০ জন। তাদের কাছে আটকে থাকা কেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
খেলাপি ঋণ বাড়ছে স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা দেওয়ার কারণে নিয়মিত গ্রাহকরাও এখন খেলাপি হয়ে গেছে। সে কারণেই খেলাপি ঋণ বাড়ছে। তবে ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ অবশ্যই কমবে বলে মনে করেন তিনি।
মুস্তফা কামাল বলেন, খেলাপি ঋণ কমাতে শুরু থেকেই আমরা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারিনি। এ কারণেই সুদ হার বেড়েছে। সুদ হার বাড়লে একটি দেশের উৎপাদনশীল খাত শিল্প খাত উন্নত হতে পারে না। এই মুহূর্তে যে কোন ভাবেই হোক এই খাতকে এগিয়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থঋণ আদালতে আটকে থাকা মামলাগুলো ব্যাংকের সুদ হার কমিয়ে আনতে বাধা হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে করেন তিনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী বলেন, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জিডিপি কমলেও আমাদের দেশের জিডিপি কমার কোন ভয় নেই। কারণ আমাদের দেশের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা কখনো কমবেনা। বরং বাড়বে।
এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর কাছে খেলাপি ঋণ বিক্রির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর কাছে খেলাপি ঋণ বিক্রিসহ কয়েকটি প্রক্রিয়া বিবেচনাধীন রয়েছে। যেগুলো ক্যাবিনেটে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে। এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীর কাছে খেলাপি ঋণ বিক্রির বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনতে গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে তারা সরকারের কাছ থেকে আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমিয়ে নেয়াসহ একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু এক অংকের সুদহার বাস্তবায়ন করেনি।
এসব সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যই ছিল সুলভ বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। নানা সুবিধা পাওয়ার পর ব্যাংকের উদ্যোক্তারা গত বছরের জুনে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেন এবং একই বছরের ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা জানান। কিন্তু গত ১৬ মাসে বেসরকারি ৪১ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র তিনটি ব্যাংক এক অংকের ঋণের সুদহার কার্যকর করেছে। গত বছরই সরকারি খাতের আটটি ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অংকে নামিয়ে আনে। এখনও বেসরকারি খাতের ৩৭ ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১২-২০ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন তা ক্ষতিয়ে দেখতেই এ বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী।