বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’।
কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে একটা সর্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। বাঙালির কাছে জীবনের অন্য নামই বোধহয় উৎসব। তা সে ঈদ কিংবা পুজাই হোক, রাষ্ট্রীয় কোনো দিবস পালনই হোক। নানা উছিলায় হুজুগে বাঙালি একজোট হতে পারলেই যেন স্বস্তি পায়! উৎসব তো জীবনের রসনির্ঝরিণী। প্রাণপুষ্পের ভোমরা। উৎসবময় জীবন অবশ্যই অনন্ত প্রাণ ভাণ্ডার।
এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষের ‘হোম সিকনেস’ বা আত্মীয়-বান্ধব-ঘরের প্রতি টান সব সময়ই অকৃত্রিম। আর ঈদ-পালা-পার্বণ বা যেকোনো উপলক্ষ তা যেন বাড়িয়ে দেয় আরো শতগুণ। মায়া-মমতা-আবেগ-অনুভূতিতে ভরা বাঙালি হৃদয় সর্বদাই ঘরমুখী। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আঁচলে চোখ মুছে যে প্রিয়জনকে রেখে জীবিকার খোঁজে এসেছিল এই শহরে, আজ ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে চিরচেনা সেই স্বজনদের মাঝে উপস্থিত হবার আকুলতা তাই সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে কর্মস্থলকে পিছনে ফেলে, নাড়ির টানে সম্মুখপানে টেনে নিয়েছে সবাইকে।
নাড়ির টানে আশৈশব কাটানো স্বজন-বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনের সাথে মিলনের জন্য গ্রামের বাড়িতে শত দুর্ভোগ সত্ত্বেও যাওয়ার জন্য মানুষ উতলা হয়ে ওঠে। বাড়ি ফেরার এই ব্যাকুলতা রুখে দেয়ার সাধ্য কার?
বাঙালি প্রতিকূল পরিবেশে সংগ্রামশীল জীবনযাপনের মধ্যেও ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা থাকতে চায়। আমরা বাঙালিরা তাই ঈদ উৎসবকেও করে নিয়েছি নিতান্তই আমাদের মতো, আমোদ-আহ্লাদে, হুজুগে-হিড়িকে থকথকে। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত এই বিশেষ দিনটিকে করে তুলেছি অসাধারণ। নিরঞ্জনকে মোহাঞ্জন পরিয়ে দেখতেই হয়তো আমরা অভ্যস্ত। সকলকে ‘ঈদ মোবারক’ বলা ঈদের দিনটি তাই অন্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। কারও কারও জন্য একটু বেশি ব্যস্ততার, আবার কারও জন্য একটু আলসেমির!
যদিও এবার আমাদের ঈদ উৎসবটি সবার জন্য সমান আনন্দের বার্তা নিয়ে আসেনি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের দুঃখে-দুর্দশা, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার থেকে স্রোতের মতো ভেসে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবেতর পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ রূপা নামে একটি মেয়েকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার ঘটনা আমাদের মনকে বিষাদময় করে তুলে তুলেছে। এসবের কারণে উৎসবের রং অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
বিশেষ করে রূপার খবরটি আমাদের বিবেককে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে! গত ২৫ আগস্ট রূপা ময়মনসিংহের কর্মস্থল থেকে বগুড়ায় গিয়েছিলেন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে। পরীক্ষা শেষে সন্ধ্যা সাতটার দিকে আরেক সহকর্মীর সঙ্গে ছোঁয়া পরিবহনের বাসে করে রওনা হন। ওই সহকর্মীর গন্তব্য ছিল ঢাকা। রাত আটটা থেকে সাড়ে আটটার দিকে বাসটি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায় এলে সহকর্মী নেমে যান।
অন্য সব যাত্রী সিরাজগঞ্জ মোড়, বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম প্রান্ত ও এলেঙ্গায় নেমে যায়। এরপর বাসটি টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কাছাকাছি এলে বাসের চালকের সহকারী শামীম তরুণীকে জোর করে পেছনের আসনে নিয়ে যায়। পরে শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গীর তাকে ধর্ষণ করে। একপর্যায়ে ঘাড় মটকে তাকে হত্যা করা হয়। পরে মধুপুর উপজেলা সদর অতিক্রম করে বন এলাকা শুরু হলে পঁচিশ মাইল এলাকায় রাস্তার পাশে লাশ ফেলে রেখে চলে যান তারা।
এই যে ধর্ষণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্ষণের পর হত্যা, নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্তমানে প্রবল হয়ে উঠেছে। কখনও শাসক দলের ক্ষমতাশালী যুবক তুফান, কখনও ধনাঢ্য স্বর্ণব্যবসায়ীর পুত্র, কখনও কামকাতর বন্ধু, কখনও আত্মীয়, কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কখনও পরিবহন শ্রমিক, যে যেখানে সুযোগ পাচ্ছে অথবা সুযোগ তৈরি করে নিয়ে হায়েনার মতো মেয়েদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।
গায়ের জোর, টাকার জোর, ক্ষমতার জোর, মোটের উপর জোরের কাছে নারী আজ পরাজিত। ভীত-সন্ত্রস্ত। আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত বড়লোকের মেয়েরাই কিছুটা নিরাপদ। সমাজের আর্থিক ভাবে সচ্ছল ও উচ্চ স্থানাঙ্কে অবস্থিত পরিবারের মেয়েদের চট করে কেউ ঘাঁটায় না৷ অপেক্ষাকৃত আর্থিক ভাবে দুর্বল ঘরের মেয়েদের ক্ষতবিক্ষত লাশই ধানক্ষেতে/বাঁশবনে পাওয়া যায়৷ যারা এই কাজগুলি করে, তারা নিশ্চিত জানে এদের ধর্ষণ করলে, মেরে ফেললে তেমন কিছুই হবে না। আর এ সব দরিদ্র পরিবারকে অর্থ দিয়ে সহজেই কিনে নেওয়া যায়।
আগের দিনের স্বেচ্ছাচারী স্বৈরাচারী রাজাদের মতো, এখনও ধর্ষণের শিকার পরিবারগুলোকেও অনেক ক্ষেত্রে আপোষ করতে হয়। পরিবারের অস্তিত্ব ও শ্লীলতারক্ষার জন্যে কী দ্বিচারিতা আমাদের সমাজের!
আমরা একদিকে উল্লসিত, আমাদের ঘরের মেয়েরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, সৈনিক, মডেল, খেলোয়াড় হচ্ছে, সব খানে সাফল্য দেখাচ্ছে। অথচ তারা স্বাধীনভাবে ঘুরতে-ফিরতে পারছে না। আমাদের সমাজের কর্তাব্যক্তিদের মুখে সেই এক কথা- ‘মেয়ে মেয়েই, ছেলে ছেলেই- কী দরকার রাত বিরেতে বাইরে বেরোনোর?’ তা হলে যে নারী পাইলটের ফ্লাইট রাত তিনটেয়, সে কি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে কখন ভোর হবে আর সে ঘর থেকে বেরোবে?
যে ডাক্তার মেয়েটি মাঝরাতে রোগীর এমারজেন্সি কল পায় সে কী করবে? যে মডেলের শুটিং প্যাকআপ শেষ হয় রাতদুপুরে, সে কী করবে? যে মেয়েটি আইটি সেক্টরে কাজ করে সে কী করবে? যে নারীটি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সেই বা কী করবে? এ রকম হাজারো পেশায় হাজারো মেয়ে রয়েছে৷ তা হলে মেয়েদের জন্য ইপিজেডের মতো আলাদা জোন তৈরি করা হবে, যেখানে তারা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় সব কাজকর্ম করে হাঁসমুরগির মতো সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে আসবে?
যে রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস সাধারণ মানুষ, যে রাজনৈতিক ক্ষমতা কাগজে-কলমে হলেও তুলে দেওয়া হচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে, সেই ক্ষমতাই বিপ্রতীপে ব্যুমেরাং হয়ে আছড়ে পড়ছে জনতার অর্ধেক অংশ নারীর ওপর? এ কেমন গণতন্ত্র যেখানে একজন নাগরিককে মানুষ হিসেবে নয়, মেয়েমানুষ বা পুরুষমানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে? প্রশাসন তাকিয়ে থাকছে, নেতা নেত্রীর মুখের দিকে, সেখান থেকে ইঙ্গিত এলে তবেই এবং ইঙ্গিত অনুযায়ী প্রশাসন নড়াচড়া করবে।
এই দেশে ধর্ষকদের শাস্তি দাবি করে মিছিল-মিটিং সমাবেশ মানববন্ধন করে কী হবে? ক্ষমতা, জোর, আর শক্তি প্রদর্শনকারী সমাজের কীটেরা কি তাতে নিরস্ত হবে? ধর্ষণ কমবে?
আমার মনে হয় এখন সময় এসেছে সামাজিক প্রতিরোধের, নারী নির্যাতনকারী ধর্ষকদের সামাজিক বয়কটের। সামাজিক বয়কট মানে সামাজিক বয়কটই। রেস্টোরেন্টে গেলে এন্টারটেইন করা হবে না, পেট্রোল পাম্পে গেলে পেট্রোল দেওয়া হবে না, পার্লারে গেলে পরিষেবা পাবে না, রাস্তায় দেখলে, লোকে আঙুল দিয়ে দেখাবে, অবজ্ঞা করবে এবং মুখ ঘুরিয়ে চলে যাবে৷ গ্রামে ধোপা নাপিত বন্ধ করে একঘরে করার কথা শুনেছি, এ বারে শহরেও তাই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাধ্যতামূলক ভাবে প্রতিটি স্কুল কলেজে ‘নারী সেল’ খুলে বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদদের দিয়ে আলোচনা-সভা ও ওয়ার্কশপ করতে হবে।
কীভাবে প্রতিটি মেয়ে প্রতিকূল অবস্থায় আত্মরক্ষা করবে ও অন্তত কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে (মাঝখানে কিছুদিন পেপার স্প্রে, বডি স্প্রে-র কথা শুনেছিলাম)। তৃতীয়ত, ছোটোখাটো কোনও ঘটনা, যেমন স্কুল বা কলেজে বা চাকরিতে আসার সময় যদি কেউ অনুসরণ করে, কট্যুক্তি করে, কুপ্রস্তাব দেয় তা হলে তা লুকিয়ে না রেখে নির্দ্বিধায় বাড়ির অভিভাবকদের জানাতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে ছেলেটি বা পুরুষ এসব করছে সমাজের সামনে লজ্জিত হতে হবে তাকে, মেয়েটিকে নয়।
চতুর্থত, প্রতিটি, বিশেষ করে মেয়েদের বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে, অফিসঘরে বড়ো বড়ো করে লোকাল থানা, মহিলা থানা, অফিসের প্রধান করণিক, প্রধান শিক্ষিকা, শিক্ষক, অধ্যক্ষ, অধ্যক্ষার টেলিফোন নম্বর লেখা থাকা দরকার যাতে আপৎকালে মেয়েরা সেটা ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়াও প্রতিটি মহাবিদ্যালয়ে, বিদ্যালয়ে Redressal Cell গঠন করতে হবে। প্রয়োজের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ স্থান সিসিটিভি-র আওতাধীন আনতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত মনোবিদের বক্তৃতা, ক্যারাটে ইত্যাদির ওয়ার্কশপ ইত্যাদির দ্বারা মেয়েদের ছোটো থেকেই আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে হবে।
প্রশাসন আমাদের বন্ধু, কিন্ত্ত তাকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দিতে হবে। বাজে পোস্টিং, ডিমোশন ও হ্যারাসমেন্টের ভয়ে যে যদি সর্বদা ত্রস্ত ও বিব্রত থাকে তা হলে কী হবে ? প্রতিটি পার্টির, ভোটের ইস্তাহারে পুলিশ প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে দেওয়ার গ্যারান্টি দিতে হবে।
সমাজ ও প্রশাসন যদি পাশে না দাঁড়ায় তা হলে এই সব পিশাচদের শায়েস্তা করা যাবে কীভাবে? কাজেই উৎসবের আনন্দের পাশাপাশি ধর্ষণ নামক ঘৃণ্য সামাজিক ব্যাধিটি থেকে মুক্তির পথ-পদ্ধতি নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে! তা না হলে রূপাদের আত্মার অভিশাপ আমাদের উৎসবের আনন্দকে কখনও আনন্দময় হতে দেবে না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)