‘বাংলাদেশে নারীদের অনেক অগ্রগতি হলেও তারা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে
নিরাপত্তাহীন।’ ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের এমন বক্তব্যের সঙ্গে
নারীনেত্রী, মানবাধিকার কর্মি ও সাংবাদিকরা একমত । তাদের মতে, দেশ যখন
এগিয়ে যাওয়ার পথে তখন নারীর অনিরাপত্তা দেশকে আরেক ধাপ পিছিয়ে দিচ্ছে।
সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভায় ড. অানিসুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে নারীদের অনেক অগ্রগতি হলেও তারা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে নিরাপত্তাহীন।’ বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সরকার কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে বা কাদের কাছে মাথা নত করছে সেই প্রশ্নও রাখেন তিনি।
ওই বক্তব্যের বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, নারীরা যে আগের চেয়ে আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে সে কথার সঙ্গে কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিমত করার সুযোগও নেই। চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখলে সেটা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছি। আজকাল নারীরা আর কেউ শৃঙ্খলে আবদ্ধ নেই। সবাই বেরিয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও কি তারা নিরাপত্তা পাচ্ছে?
তিনি বলেন: আগে নারীর শিক্ষা গ্রহণেরই সুযোগ ছিলো না। এখন সেটা হয়েছে। আগে নারীদের সেই সূচিকর্ম, রন্ধনশিল্প এই ধরনের শিক্ষাই গ্রহণ করতে হতো। ধারণা ছিলো কঠিন বিষয়গুলো নারীরা বুঝতে পারবে না। এখন সেই জায়গাটা বদলেছে। নারীরা এখন গণিত, বিজ্ঞান সব বিষয়েই পড়াশোনা করছে।
‘কিন্তু, নিরাপদ কি হতে পেরেছেন তারা?’
একই কথা বলেন বেসরকারি সংস্থা নিজেরা করি’র নির্বাহী পরিচালক খুশি কবির। তার মতে, একটি উন্নয়নশীল সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হলো নিরাপত্তাহীনতা।
‘আমার হাতে টাকা, খাবার, বাসস্থান সবই আছে কিন্তু নিরাপত্তা নেই। তাহলে কিভাবে হবে? সবচেয়ে বড় ঝুঁকিটা হচ্ছে এই কারণে যে সরকার এটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। নারীরা শুধু যে ঘরের বাইরে অনিরাপদ তাই নয়। এখনকার সমাজব্যবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নারীরা নিজের ঘরেও অনিরাপদ।
নারী বিষয়ক পোর্টাল ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ সম্পাদক সুপ্রীতি ধর চ্যানেল আই অনলাইনকে বললেন, এখন মেয়েরা যতোটা অনিরাপদ, এতোটা অনিরাপদ নারীরা ষাটের দশকেও ছিলো না বলেই মনে হয় আমার। হয়তো এর আগেও অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু সেগুলো তেমন সামনে আসেনি।
‘মিডিয়া বা অন্য মাধ্যমে এসব সামনে নিয়ে আসার কারণ একটাই: সেই অন্যায়টা কমানো। কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা তো কমছেই না বরং যেন ক্রমাগত বাড়ছে। এর আগে যখন দেশে এসিড সন্ত্রাস শুরু হলো তখন সাংবাদিকরা লেখালেখি শুরু করলেন। এর ফলে কি হলো, এসিড ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা এলো। আইন হলো। এখন তাহলে তেমন হচ্ছে না কেনো?’
সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ
সমস্যা থাকবেই, তবে সমস্যার সমাধানের উদ্যোগটা সবাইকে নিতে হবে বলে মনে করছেন তিনজনই। তাদের মতে এজন্য সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হতে হবে সরকারকে। সঙ্গে পরিবারগুলোকেও সচেতন হতে হবে।
খুশি কবিরের মতে, বাংলাদেশে যে এসব অঘটন-অন্যায় ঘটছে সেটা মেনে নেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে যেসব পরিসংখ্যান আসে সেখানেও বাস্তব চিত্র উঠে আসে না। নারী যে অনিরাপদ সরকারকে এই সমস্যা স্বীকার করে নিতে হবে। তারপর সেটার সমাধানে চেষ্টা করতে হবে।
বর্তমান অবস্থায় হতাশ হলেও রাষ্ট্রের পদক্ষেপকেই একমাত্র উপায় মনে করছেন সুপ্রীতি ধর।
তিনি বলেন: দেশে আজ ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। এসব অন্যায়ের বিপক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।
‘তবে একটি ভালো দিক হচ্ছে, মেয়েরা এখন কথা বলছে। তারা কথা বলতে চায়। এবং মেয়েরা বলছেও,’ বলে মন্তব্য করেন ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ সম্পাদক।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযাযী, শুধু গত তিনমাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৪৬ নারী, ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ১০ নারীকে। ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর দুই নারী আত্মহত্যা করেছেন।
নারী নির্যাতন বন্ধে সরকারই সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারে
বলে মনে করেন নারীনেত্রী আয়শা খানম। তিনি বলেন: তারা নিজেরা কিছু আইন করুক। সবার সঙ্গে বসুন, আলোচনা করুন তারপর যে
সমাধানটা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে সেটা পালন করুন। দেখবেন সমস্যার
সমাধান আসবেই।
‘নারীকে গৃহকোণে বন্দী করা কোনো সমাধান নয়। মাথাব্যথা হলো বলে মাথা কেটেই ফেলে দেবো সেটা হওয়া উচিত না। বরং দরকার সেটার প্রতিষেধক।’
পরিবারে ছেলেকে ঠিকভাবে গড়ে তুলুন
খুশি কবির বলেন, এখনকার পরিবারে সদস্যদের মধ্যে দূরত্ব বেশি। সেটা কমিয়ে আনতে হবে যতোটা
সম্ভব। ‘আর মেয়ের পাশাপাশি ছেলের মানসিকতা গঠনের উপরও নজর রাখতে হবে,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাশাপাশি তিনি সমাজের মানসিকতা বদলানোর কথাও বলেন।
‘যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে
সমাজে সে-ই কেন ছোট হয়ে থাকবে? মানুষের সম্মান কি তার যোনীতে থাকে? একটি
মেয়েকে কেনো একজন মানুষ হিসেবে দেখা হবে না? যে খুন হলো সে যেমন দোষী নয়, যে
ধর্ষণের শিকার হলো সেও তো দোষী নয়।’