একটি মিছিল এগিয়ে যাচ্ছে। মিছিলের সবার হাতে প্রজ্বলিত মোমের শিখা। বসন্তের উথাল-পাথাল বাতাস সেই মোমশিখা নিভিয়ে দিতে চায়। এক হাতে মোমদণ্ড অন্য হাতের আঙুলকে ঢাল বানিয়ে সেই শিখাকে নিভতে না দেয়ার প্রাণময় চেষ্টা; আর কণ্ঠে সেই অবিনাশি গান- ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে/ এজীবন পুণ্য করো দহন-দানে।’ আলোর এ মিছিল এগিয়ে চলে, এই শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে।
১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ রাতে এই আলোর মিছিল শুরু করেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ১৯৭১ সালে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছেলেকে উৎসর্গ করা জননী জাহানারা ইমাম। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ১৯৯১ সালে। গঠন করেছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। আর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের ‘কালরাত্রি’কে স্মরণ করতে ৯৩ সালে শুরু করেছিলেন ‘আলোর মিছিল’। জাহানারা ইমাম চলে গেছেন তার সময়ের প্রয়োজন মিটিয়ে। তার সেই আলোর মিছিল এখন বয়ে নিয়ে চলেছে নতুন প্রজন্ম।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নির্বাচারে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। সেই থেকে এই রাতটি ইতিহাসে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। প্রথমবার খুব বেশি মানুষ জড়ো হননি, হতে পারেন নি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বৈরি রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজমান। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা সবখানে। বিএনপির নিকট মিত্র যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ‘প্রধান যুদ্ধাপরাধী’ গোলাম আযমের মৃত্যুদ- ঘোষিত হয়েছে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গঠিত গণআদালতে। সেই রায় কার্যকরের জন্য রাজপথে আন্দোলনে করছে নির্মূল কমিটি। আর সরকার তার মিত্রকে রক্ষায় মরিয়া। গণআদালতের রায় কার্যকর দূরে থাক; গণআদালতের উদ্যোক্তা জাহানারা ইমামসহ ২৪জন বিশিষ্ট নাগরিকের নামে দেশদ্রোহের মামলা দেয় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। সেই ‘দেশদ্রোহ’ অপবাদ নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে শহীদমাতা জাহানারা ইমামকে। তবে তিনি যে আলোর মিছিল শুরু করে গেছেন তা প্রতিবছর একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে এখন বিশালত্ব ধারণ করেছে। ৯৩ সালে জাহানারা ইমাম তার মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের নিয়ে, শত বৈরি পরিবেশে যে আলোর মিছিল শুরু করেছিলেন তা এখন এক চেতনার মিছিলে রূপ নিয়েছে। আজ, এই রাতে শহীদ মিনার এলাকায় গেলে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। আর শহীদ জননীর পথ ধরে এবছর থেকে কালরাত্রিকে স্মরণ করার আরো একটি উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তাহলো একই সময়ে সারা দেশে এক মিনিটের জন্য আলো নিভিয়ে দেয়া। হতে পারে এটা কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। সরকার বলছে এটা কোনো বাধ্য-বাধকতার বিষয় নয়। তবে এ ঘোষণা আর উদ্যোগ-যা-ই বলা হোক না কেনো, এটা অন্য তাৎপর্য বহন করে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই রাতে আমাদের ওপর যে বর্বর হামলা-হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার প্রতি ধিক্কার জানাতে, ঘৃণা জানাতে দেরিতে হলেও এমন আয়োজন প্রয়োজন। এসব আয়োজনে বিশ^কে জানিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতার কথা। বাংলাদেশের সৃষ্টির সময় পাকিস্তানের অপরাধের জন্য তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিটি এভাবেই জোরালো হতে থাকবে।
প্রতিবছর একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ২৫শে মার্চেও কালরাত্রি- স্মরণ করতে মিলিত হয় শহীদ মিনারে। সেখানে আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা। তারপর শহীদ সন্তানদের হাতে দেয়া হয় আলোর এক একটি মশাল। সেই মশালের আলো থেকে জ¦লে উঠে শত শত- মোমের শিখা। সেই প্রজ্বলিত শিখার আলো মিছিল ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠের কাছে। সেখানে গড়া হয়েছে ‘৭১-এর শহীদরে স্মৃতির মিনার। সেই মিনারে স্থাপন করা হয় শত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ সন্তান আর এ প্রজন্মের সন্তানদের হাতের মোম শিখাটি।
১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে আলোর মিছিল শুরু হয়েছিলো, সেই মিছিলের চিত্র ধারণ করেছিলেন অভিনয়শিল্পী-প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা কাওসার চৌধুরী। তিনি ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় গণহত্যার ওপর একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘সেই রাতের কথা বলতে এসেছি’- নামের চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়েছে প্রথম আলোর মিছিলের কিছু দৃশ্য। সেখানে এক শহীদ-সন্তান তার সন্তানকে নিয়ে এসেছেন মিছিলে। ছোট্ট সন্তানকে কেনো এনেছেন এই আলোর মিছিলে সেই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন ওই শহীদ সন্তান।
২০১৮ সালের ২৫ শে মার্চের রাতে শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল হবে। শত শত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্য আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের মানুষ অংশ নেবে এই আলোর মিছিলে। এই মিছিলে একদা শামিল ছিলেন মহান মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার শওকত আলী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, কবি শামসুর রাহমান, ভাষা সৈনিক গাজীউল হক, আবদুল জলিল, কাজী আরেফ আহমেদ, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তারা আজ প্রয়াত। বর্তমান সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী অংশ নেন আলোর মিছিলে। আর এই মিছিলটি বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা আর শহীদ পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।