আমেনা। নিষ্পাপ এক দেবশিশু। জন্মের সময় চিরতরে হারায় মাকে। মা কি? দেখতে কেমন? কি করে? মাকে নিয়ে তার এমন হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু একটিও উত্তর জানা নেই ছোট্ট আমেনার। আসলে মা শব্দের সঙ্গে আজও পরিচিত হতে পারেনি সে।
মায়ের স্নেহ-আদর-ভালোবাসা বঞ্চিত সেই আমেনা আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে অন্য শিশুদের দেখে সে বুঝতে পারে- মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা আলাদা। আস্তে আস্তে তার মধ্যে মাকে কাছে পাওয়ার আকুতি জাগে। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে দেখা হলেই মাকে কাছে পাওয়ার আবদার করতো।
সাত বছরের আমেনার এমন আবদার রক্ষার ক্ষমতা তার পরিবারের সদস্যদের ছিল না। তাই নানা কৌশলে তাকে মায়ের কথা ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন তারা। কিন্তু ছোট্ট আমেনার বিষন্ন চোখ-মুখের ছবিই বলে দিতো, সেই কৌশল ধরে ফেলেছে সে। তবুও মাকে খুঁজে বেড়ায় তার অবুঝ মন। আমেনার থাকা-খাওয়ার কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আছে মায়ের জন্য শূন্যতা। যে শূন্যতা পৃথিবীর কোনো কিছু দিয়েই পূরণ হওয়ার নয়।
ঘটনা চক্রে আমেনার খোঁজ পেয়ে যায় ‘পুষ্পকলি’ নামে শিশুদের একটি স্কুলের সদস্যরা। শুরুতে তারা আমেনাকে নিজেদের কাছে নিয়ে তার দেখাশোনার দায়িত্ব নেন। পরে ‘স্পন্সর অ্যা চাইল্ড’ এর মাধ্যমে ছোট্ট এ শিশুটির মায়ের দায়িত্ব নেন রেশমা জাহান। আমেনা এখন চড়া আর উচু স্বরে তাকে মা বলে ডাকে। রেশমা জাহানও ছুটে আসেন কোনো উপলক্ষ্য পেলেই। নিজের জীবনের বিশেষ দিন, উৎসব ভাগ করে নেন আমেনাসহ অন্য শিশুদের সাথে।
আরেক শিশু গোলাম রাসুল নাছিম। বছরের বেশিভাগ সময়ই সে অসুস্থ থাকে। ২০১৮ সালে তার অসুস্থতা আর বাবার স্বল্প আয় এই দুয়ের দ্বন্দ্বে নাছিমসহ তিন ভাই-বোনের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
‘পুষ্পকলি’র মূল প্রতিষ্ঠান ‘সম্ভাবনা’ ২০১৯ সালে সেই নাছিমের সন্ধান পায়। নাছিমসহ তার তিন ভাই-বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। সাথে চলতে থাকে নাছিমের চিকিৎসাও। প্রায় ছয় মাসের চিকিৎসায় পর নাছিম সুস্থ হয়ে ফিরে আসে।
মাতৃস্নেহ বঞ্চিত আমেনা কিংবা অভাবের চাকায় পিষ্ট নাছিমই নয়, এমন দুস্থ-সুবিধাবঞ্চিত অসংখ্য পথশিশুকে ২০১১ সাল থেকেই সেবা দিয়ে আসছে ‘পুষ্পকলি স্কুল’। অবৈতনিক এ স্কুলটি পরিচালনা করছে অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘সম্ভাবনা’। রাজধানীর মিরপুরের ১৪ নম্বর সেকশনের কালশি এলাকায় অবস্থিত স্কুলটির বর্তমান শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২০ জন।
‘সম্ভাবনা’র অন্যতম উদ্যোক্তা মুসফিকা জান্নাত নিশাত স্কুলটি সম্পর্কে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা শুরু করেছিলাম ২০১১ সালে। প্রথমে মিরপুর স্টেডিয়ামের পাশে পথশিশুদের নিয়ে কার্যক্রম শুরু করি, পরে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে কার্যক্রম পরিচালনা করি। ওই সময় আমরা সুবিধাবঞ্চিত ও পথশিশুদের লেখাপড়া শেখাতাম।’
‘‘তবে ২০১৬ সাল থেকে কালশিতে এই এলাকার বস্তিতে বসবাস করা বাচ্চাদের নিয়ে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করি। মিরপুর স্টেডিয়াম ও রবীন্দ্র সরোবরের স্কুল আমরা ২০১৭ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করেছি।’’
শুধু পথশিশু নয়, বঞ্চিত শিশুদের পরিবারকেও স্বাবলম্বী করতে কাজ করছে সম্ভাবনা।
তিনি বলেন, ‘পথশিশুরা মূলত পারিবারিক অভাব অনটনের মাধ্যমে রাস্তায় নামে। যাদের পরিবারের অবস্থা বেশি নাজুক, সেসব শিক্ষার্থীদের আমরা খুঁজে বের করি এবং শিক্ষা কার্যক্রমের মধ্যে নিয়ে আসি।’
‘‘এসব শিশুকে স্কুলে বিনামূল্যে পড়াশুনা পাশাপাশি তাদের পরিবারকেও স্বাবলম্বী করতে তাদের মায়েদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। বলতে গেলে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পরিবারে অধিকাংশ সময়ই বাবা থাকে না। স্বাভাবিকভাবেই তারা মায়ের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকে। এসব শ্রেণীর মায়েদের কর্মক্ষেত্রে পারিশ্রমিকও অনেক কম। এ কারণে তারা সন্তানের সঠিক লালন-পালন করতেই পারে না। উপরন্ত শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করে। আমরা এমন ১৫ জন মায়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পর তারা এখন পরিবারের জন্য কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারছে।’’
এমন শিশুদের নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনা জানতে চাইলে মুশফিকা জান্নাত চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা পথশিশুদের পুনর্বাসন করতে চাই। কারণ সাধারণ স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তারা স্কুল করতে পারে না। আবার যাদের পরিবার নেই, তাদের থাকার ব্যবস্থা না করলে শিক্ষা দিয়ে কী করবে? শিক্ষা নিয়ে তো ওকে রাস্তায় থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেওয়ারও জায়গা থাকে না। এসবের জন্য আমাদের কাছে এর সমাধান মনে হয় একটি পুনর্বাসন কেন্দ্র। এটা খুবই প্রয়োজন।’’
২০২৫ সাল নাগাদ একটা পুনর্বাসন কেন্দ্র করার ব্যাপারে তাদের একটি পরিকল্পনা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পাশাপাশি আমাদের যে পুষ্পকলি স্কুলটা আছে সেটাকে আধুনিককরণ করতে চাই।’
‘‘আমরা চাই না আমাদের স্কুলের বাচ্চারা ভবিষ্যতে শিক্ষিত বেকারে পরিণত হোক। দক্ষতা মূলক শিক্ষা আমরা দিতে চাই। আমাদের ১২০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কিন্তু সবাই ভালো শিক্ষার্থী তা নয়। কেউ তথ্য প্রযুক্তি ভালো বুঝে কেউবা খুব সুন্দর নাচতে পারে।
আমাদের পরিকল্পনা প্রত্যেক বাচ্চাকে দক্ষ একজন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি পথে যেসব বাচ্চা আছে, তাদেরকে যেন আমরা আশ্রয় দিতে পারি।’’
সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানটির শুরুর কথা জানতে চাইলে এর আরেকজন উদ্যোক্তা আরিফুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল পথশিশুরা যেন ভিক্ষাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত না হয় এবং মাদকাসক্ত না হয়। আমরা সবসময় চেয়েছি শিশুরা মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে গড়ে উঠতে পারে।’
‘‘আমরা আড্ডা দিতে গিয়ে দেখেছি শিশুরা খেতে পারছে না, ভিক্ষা করছে। আমরা ভাবলাম শিশুগুলোর যেমন খাবার জরুরি, তেমনি শিক্ষাটাও জরুরি। শুরুর দিকে আমরা (আমি, রবিউল ইসলাম) পথশিশুদের পড়াতাম আর পড়া শেষে রুটি-কলা এই টাইপের খাবার দিতাম। যাতে করে খাবারের লোভে হলেও পড়াশুনাটা শিখছে।’’
আরিফুল ইসলাম জানান, তাদের প্রথম ব্যাচের একজন শিক্ষার্থী মো. মারুফ হোসেন এখন বরিশাল পলিটেকনিকে পড়ছে। কিছু শিক্ষার্থী আছে যারা জেএসসি দিয়েছে, যাদেরকে জার্মান টেকনিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও কয়েকজন দশম শ্রেণীতে পড়ছে।
স্কুলের স্পন্সরের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সম্ভাবনার ব্যাপারে দুটি প্রজেক্ট পরিচালনা করছি, একটা পুষ্পকলি স্কুল ও মায়েদের যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি সেটা অনিন্দিত নারী।’
‘‘২০১৭ সাল পর্যন্ত আমাদের খরচ খুব কম ছিল, যেহেতু খোলা আকাশের নীচে পাঠ্যদান করানো হতো। তখন পর্যন্ত আমরা নিজেরাই এই খরচ বহন করেছি। ২০১৭ সালের পর আমরা একটা স্পন্সরশিপের আয়োজন করি। ১০০০ হাজার টাকায় একটা বাচ্চার পড়াশুনা ও মায়ের প্রশিক্ষণ হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ৫৭ জন শিশু কয়েক ব্যক্তির স্পন্সরের টাকার পড়াশুনা করছে।
এর বাইরে সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের দায়িত্ব নিয়েছেন। সমাজের অন্য সাধারণ শিশুর মতো করেই গড়ে তুলেছেন তাদের।’’
সেই ব্যক্তিদের একজন ফাতিমা শারমীন। যিনি মহাখালী আমতলী স্টাফ ওয়েলফেয়ার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক। তিনি গত ১১ বছর ধরে নীরবে-নিভৃতে সুবিধাবঞ্চিত স্কুলের শিশুদের পড়াশুনার পাশাপাশি খাবার, কাপড় ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে।
লালবাগের একটি স্কুলে শিক্ষকতার সময়ে নূর মোহাম্মদ নামের এক শিক্ষার্থীর অভাব অনটনের খবর জানতে পারেন ফাতিমা শারমীন। ওই শিক্ষার্থীর বাবা রাস্তায় শুটকি মাছ বিক্রি করতেন। অভাবে সংসার ঠিকমতো চালাতো না। সব কিছু বুঝতে পেরে ওই শিক্ষার্থীর দেখাশুনার দায়িত্ব নেন ফাতিমা শারমীন।
পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ধানমন্ডির গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ভর্তি করান নূর মোহাম্মদকে। চলতি বছর ওই শিক্ষার্থী নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেবেন তিনি।
প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ জন শিক্ষার্থীর জামা, কাপড়, বই-খাতার খরচ বহন করেন ফাতিমা শারমীন। প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশ জন শিক্ষার্থীর নাস্তার টাকাও দেন তিনি।
বর্তমানে তার বাসায় স্কুলের ঝুমা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী থাকছেন, তার যাবতীয় লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন। ওই শিক্ষার্থী মেধাবী, কিন্তু বাবার কর্মক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার পরিবারের রাজধানী ছাড়তে হয়। মেধাবী ওই শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার আগ্রহ থাকলেও সেটা সম্ভব হচ্ছিল না, পরে ওই শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেন শারমীন নিজেই।
জানতে চাইলে ফাতিমা শারমীন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘আমি আমার সাধ্যের মধ্যে যতোটুকু পারি সেটা করার চেষ্টা করি। আসলে ঢাকায় থাকা আমাদের শ্রমিক শ্রেণীর মানুষরা কর্মক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঢাকা ছাড়া হচ্ছেন। ফলে কেউ ঝরে পড়ছে আবার কেউবা বছর লস করে ড্রপ আউট হচ্ছে।
‘‘গত দুই-তিন বছরের মধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কারণ বিভিন্ন বস্তিতে আগুন লাগার কারণে তারা সবকিছু হারাচ্ছে। কিছুদিন আগে কড়াইলের বস্তিতে আগুনে স্কুলের এক শিক্ষার্থী শুধুমাত্র সে আর তার মা ঘর থেকে বের হতে পেরেছিল। পরে সব শিক্ষকরা মিলে স্কুল ড্রেস কেনার টাকা দিলেও তাদের ঘরে থাকা টিভি-ফ্রিজ সব আগুনে শেষ হয়ে গেছে। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো সাহায্য পাবে, আবার অধিকাংশ অসৎ পথে চলে যাবে।’’
দুস্থ শিশুরা কেন পথে আশ্রয় খুঁজছে? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন ‘নানা কারণে অনেক গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফুটপাত থেকে তুলে দেওয়া হচ্ছে অনেককে। আবার বস্তির আগুনে অসংখ্য পরিবার ঘরহীন হচ্ছে। আসলে আমাদের চিন্তা করতে হবে কেন শিশুরা সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে? কারণটা সরকারের নীতি-নির্ধারকদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আমাদের মতো কে, কাকে, কতোটা সাহায্য করল- সেটা মুখ্য বিষয় নয়।’