কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি কিংবা লাভজনক কোনো কর্মসংস্থানের বাইরে থাকা গৃহিণীদের সংসারের কাজকে অর্থের মাপকাঠিতে মাপা না গেলেও পরিবারের ব্যবস্থাপক হিসেবে যথাযথ স্বীকৃতি তাদের প্রাপ্য।
মঙ্গলবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত ‘নারীর অস্বীকৃত কাজের স্বীকৃতি প্রদান এবং জিডিপিতে তার অন্তর্ভুক্তকরণ’ বিষয়ে এক আলোচনায় এসব কথা উঠে এসেছে।
অর্থনীতির সমৃদ্ধি বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য নারীর অস্বীকৃত এসব কাজের স্বীকৃতি দরকার উল্লেখ করে আলোচনা সভার বক্তারা বলেন, গ্রামীণ সমাজে যে নারীরা কৃষি কাজ করেন, ফল-সবজি চাষ করেন, গবাদি পশু পালন করেন; তাদের শ্রমের মূল্যায়ন হয় না। সংসারের অনুৎপাদনশীল কাজের স্বীকৃতি এবং উৎপাদনশীল কাজের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ সমতা সৃষ্টি সম্ভব।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক ড. সেলিম জাহান বলেন, সংসারে, কৃষিখেতে নারীর মজুরিবিহীন কাজগুলো স্বীকৃতি পায় না। তবে তাদের সব কাজ অর্থের মাপকাঠিতে মাপাও যায় না। নারীর অস্বীকৃত কাজগুলোর স্বীকৃতি আদায়ের আলোচনায় প্রথমে নারীর এই অস্বীকৃত কাজগুলোর প্রকৃতি বুঝে তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
তিনি বলেন: নারীর মজুরিবিহীন কাজ এবং মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের মধ্যে পার্থক্যটি বুঝতে হবে। মজুরিবিহীন সেবাকর্মগুলো মজুরিবিহীন সাধারণ কাজের অংশ। কিন্তু সব মজুরিবিহীন কাজই তো আর সেবাধর্মী মজুরিবিহীন কাজ নয়। সন্তান লালন নারীর মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজ কিন্তু ফসল উৎপাদনে কৃষিখামারে তার কাজটি অবশ্যই সেবামূলক মজুরিবিহীন কাজ নয়। শুধু বাংলাদেশ নয় হিসেব মতে পুরো পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজ করে নারীরা।
‘নারীর এই মজুরিবিহীন সেবামূলক ভূমিকাগুলো অর্থের মাপকাঠিতে মাপা না গেলেও তাদের সঠিক মূল্যায়ন, স্বীকৃতির মাধ্যমে মর্যাদা জানানো দরকার। অন্যদিকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য নারীর মজুরি বিহীন সাধারণ কাজগুলোকে মূলধারার শ্রমগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্তি প্রয়োজন।’
আলোচনার প্রধান অতিথি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. শামসুল আলম জানান, নারীর মর্যাদাপূর্ণ ক্ষমতায়নে সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে।
তিনি বলেন: বাংলাদেশ বিশ্বের ৪৪ তম অর্থনীতির দেশ, ক্রয় সক্ষমতার বিচারে আমাদের অবস্থান ৩৪। জিডিপি প্রবৃদ্ধির আলোকে এই অবস্থানে।
আলোচনায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনের বরাতে শামসুল আলম বলেন, যে তথ্য আপনারা তুলে ধরেন তা খুবই আশা জাগানো। দেখা যাচ্ছে নারীদের অস্বীকৃত কাজগুলোকে স্বীকৃতি দেয়া গেলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে তা ৮৭ শতাংশেরও বেশি ভূমিকা রাখবে। তবে আপাতত অপরিপক্ক অর্থনীতির দেশে আমরা চাইলেও সব কিছুর প্রতি সঠিকভাবে নজর দিতে পারছি না। কিন্তু অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
নারী উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন: নারীর ক্ষমতায়নকে সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখে। আমাদের সাম্প্রতিক বাজেটের বড় একটি বরাদ্দ সরাসরি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে বেড়েছে নারী সদস্য, সংসদে নারীর আসন সংরক্ষিত। আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়েও নারী সচিবদের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে অস্বীকৃত কাজের মূল্যায়ন, অন্তর্ভুক্তিসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর প্রতি আচরণগত পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন আলোচনায় উপস্থিত ব্যক্তিরা।
আলোচনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিয়া সেপ্পো বলেন: জেন্ডার বৈষম্য দূর করাটা নারীদের এজেন্ডা নয়। জেন্ডার সমতার অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা রয়েছে। নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক অগ্রসরতার জন্য জাতিসংঘের ইউএন উইমেন ‘হি ফর শি’ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। নারীর প্রতি সমাজে প্রচলিত দৃষ্টি ভঙ্গি, আচরণের পরিবর্তন প্রয়োজন। এজন্য সবাইকে এক হয়ে সমমর্যাদার পথ সুগম করতে হবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর ‘মর্যাদায় গড়ি সমতা’ প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে আয়োজিত এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা ড. রিজওয়ানুল ইসলাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা আকতার খাতুন প্রমুখ।