চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বেতন না পাওয়ায় নারীর কাজের স্বীকৃতি নেই? 

আমরা জানি যে পুরুষের মতো নারীর কাজ শক্ত গোছের না হলেও সংখ্যার বিচারে একজন পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করে যেতে হয় একজন নারীকে । ঘর মোছা, বাসন- কোসন মাজা, কাপড় কাঁচা থেকে শুরু করে এমন এমন দৈনন্দিন কাজ সারাদিন ধরে করতে হয় যে সংসারটাকে ভালো মতো আগলে রাখতে হলে তাকে সারাক্ষণ কাজের পিছনে ছুটতেই হয় । নিজেকে সময় দেবার মতো একটু সময় থাকে না । একটু ফুরসৎ নেবার যেন সময় নেই তার ।একজন নারী এতো কিছু করার পরও তাকে তার স্বামী বা বাড়ির অন্যদের কাছ থেকে শুনতে হয় সারাদিন কী করো? খালি খাও আর ঘুমাও…।

আমি আমার বাবা-মার কথায় বলি । আমার বাবার এখন বয়স হয়েছে । আগে ব্যবসা করতো । এখন অর্থ আয়ের কোন চিন্তা না থাকায় বাবা সারাদিন বসেই থাকে । সময় যেন তার কাটে না । কখনও বাড়ির কাছাকাছি বাজারের দোকানে, কখনও টিভি দেখে, কখনও বা চায়ের স্টলে গল্প বলে বা গল্প শুনে তার সময় কাটে । জীবনের একটা উৎপাদনশীল সময় শেষ হবার পর পুরুষ মানুষের যেন আর কোন কাজ নেই । কাজ তাকে চিরদিনের জন্য ছুটি দিয়েছে ।
কিন্তু আমার মা; আমার মায়ের কি কাজ থেকে মুক্তি মিলেছে? প্রতিদিন সংসারের সব কাজ যেমন রান্না করা , ঘর মোছা, গরুছাগল পালা, তাদের খাবার দেয়া, আব্বা ও তার নিজের কাপড় কাঁচা সবই আম্মাকে একা সামলাতে হয় ।

আব্বার চেয়ে মাত্র ৩-৪ বছরের ছোট হলেও ছেলে হবার সুবাদে আব্বা কাজ থেকে নিষ্কৃতি পেলেও আম্মার কিন্তু কোন ছুটি নেই । এমনকি যদি আমার বাড়িতে বেড়াতে আসতে চায় তাহলে আব্বা কীভাবে খাবে, তার সব কিছু ঠিক ঠাক মতো কীভাবে চলবে এই টেনশনে আসতে পারেন না সেভাবে । অবশ্য অনেক সময় আব্বা ও আম্মা একসাথে চলে আসে ।

আম্মা ছাড়া আব্বা অচল বলতে । আব্বা নাকি মাঝে মাঝেই আম্মাকে বলে আমার আগে তুমি মারা গেলে আমি কিভাবে চলবো? সত্যি আমরা যদি ভালভাবে চিন্তা করে দেখি তাহলে দেখা যাবে যে পুরুষরা নারীর উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল । এজন্য হয়তো একজন পুরুষের স্ত্রী মারা যাবার কয়েক মাস না পেরুতেই বিয়ে করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে । অন্যদিকে একজন স্বাবলম্বী ও সন্তান আছে এরকম নারী বিয়ে না করে সারা জীবনের জন্য বৈধব্যকে বরণ করে সময় পার করে দেয় । যদিও তার নিজের জীবনের কথা চিন্তা করে বিয়ে করা উচিৎ বলে আমি মনে করি ।

আব্বার আম্মার এই অবস্থা দেখে আমার ভারতীয় বাংলা ছবি “বেলা শেষে” এর কথা মনে পড়ে গেল ।ওখানে দুই বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার মনোমালিন্য হবার কারণে বৃদ্ধা মহিলা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে যায় । বেশ কয়েকটা দিন সে স্বামী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে । সে অন্য জায়গায় গিয়ে কাপড় সেলাইয়ের কাজ করে ঠিকই নিজের পায়ে নিজে স্বাবলম্বী হয়ে দিন পার করছেন । কিন্তু বৃদ্ধ স্বামী কিন্তু পারছেন না । উনি যখন জুতা পড়তে যাবেন তখন জুতা খুঁজে পান না । চা খেতে চাইলে চা খেতে পারেন না । রান্না করে কে খাবার সামনে বেড়ে দেবে? কেউ নেই… । তখন পদে পদে বৃদ্ধ স্বামীর তার স্ত্রী কথা মনে পড়তে লাগলো । পরে তিনি স্ত্রীকে বাসায় ফিরে নিয়ে আসেন এবং বলেন “বিধাতা যেন আমার আগে কখনও তোমাকে না নেন । ”

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম তার একটি আর্টিকেল “ দুর্যোগ সব সামলান নারী, নাম হয় পুরুষের” তিনি বলেন- “আমরা কথায় বলি নারীর ক্ষমতায়ন দরকার । এমনকি বলি এখন নারীর ক্ষমতায়ন অনেকটা এগিয়েছে । কিন্তু বাস্তবে তা নয় । ঘরদোর সামলান নারী । দুর্যোগে সব বিপদ আপদ থেকে বাঁচার উপায় বের করতে হয় তাকেই । আর পরিবারের প্রধান হিসাবে পুরুষের খবরদারিটাই শেষ পর্যন্ত আসল ব্যাপার হয়ে দাড়ায় । সব ক্রেডিট জমা হয় পুরুষের খাতায় । নারীর কাজের মূল্যায়ন হয় না । এভাবে নারীর ক্রেডিট হাইজ্যাক হয়ে চলেছে গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে ।”

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম বলেন – “নারীকে সম্মান দিতে হবে । সংসারের কাজ, মাঠের কাজ, চুলায় চোখ পুড়িয়ে রান্নার কাজ, এমনকি ধান বোনা,- কাঁটা- মাড়াই প্রায় সব কাজই করেন নারী । কিন্তু এসব কাজের বেতন পান না বলে তার কাজের স্বীকৃতি নেই । তাই মর্যাদা পান না । অথচ এই নারীই দুর্যোগে টিকে থাকার আগাম প্রস্তুতি হিসাবে প্রতিদিন একমুঠো করে চাল সংরক্ষণ করেন । পরিবারের আর কার মাথায় এমন বুদ্ধু খেলে?

তাইতো এই সম্মান অর্জন করতে নারী আজ মরিয়া হয়ে উঠেছে । অর্থ উপার্জনের জন্য মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে বা হচ্ছে । কিন্তু মাঠে নেমে পুরুষের সাথে সমানতালে পা মিলিয়ে, অনেক ক্ষেত্রে তাদের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করেও প্রাপ্য সম্মান মিলেছে কি তার? দিন শেষে একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী, দায়িত্বশীল মা, দায়িত্বশীল ছেলের বউ না হয়ে উঠতে পারার তকমা জোটে কপালে!

নারীর প্রতি সকল অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের পরিসমাপ্তি ঘটুক । নারী-পুরুষ মিলে গড়ে উঠুক এক অসাধারণ সুন্দর সমাজ । আমরা সব দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থের নারী কবিতার সুরে বলি-
“সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বে যা-কিছু মহান্‌ সৃষ্টি চির-কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)