যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার শত বছর বয়সে মারা গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে একজন প্রভাবশালী মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে তিনি সারা বিশ্বে আলোচিত হয়েছেন। শুধু আলোচিতই নয়, তিনি সমালোচিতও হয়েছেন। এরমধ্যে বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি সমালোচিত ছিলেন।
কিসিঞ্জারের নানা বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তাকে অনেকেই ‘যুদ্ধাপরাধী’ বলে অভিযুক্ত করে থাকেন। হেনরী কিসিঞ্জারদের কূটচালের ফলে বদলে গেছে অনেক রাষ্ট্রের সরকার ও শাসনব্যবস্থা। রক্ত ঝরেছে অগণিত নিরীহ মানুষের। এজন্য তার মৃত্যুর পরও আন্তর্জাতিক নিউজ পোর্টালগুলোর কমেন্ট সেকশন ভরে উঠেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন সাবেক এই কূটনীতিক। এমনকি বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করে তিনি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলেও অভিহিত করেছেন। অবশ্য তিনি শেষ সময়ে ভিন্ন এক বাংলাদেশ দেখে গেছেন। যেই বাংলাদেশ তার প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ‘টক্কর’ দিতে পারে।
হেনরী কিসিঞ্জার জন্মেছিলেন জার্মানিতে। হিটলারের নাজিবাহিনীর ইহুদীদের আর ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে তীব্র জাতিগত নির্মূলাভিযান শুরু হলে ১৯৩৮ সালে পিতামাতার হাত ধরে পালিয়ে আসেন আমেরিকায়। কারণ তারা ছিলেন ইহুদী ধর্মাবলম্বী। ভাবতে অবাক লাগে জাতিগত বিদ্বেষ আর ঘৃণার ফলে মাতৃভূমি ছেড়ে বাস্তুহারাতে পরিণত হওয়া এই মানুষটির কূটচালেও বিশ্বজুড়ে পরবর্তীকালে বাস্তুহারা হতে হয়েছিল অগণিত মানুষ।
অসাধারণ তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী এই মানুষটি পড়াশোনা করেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে শুরু করে অসাধারণ মেধার গুণে হন ফ্যাকাল্টি মেম্বার। এরপর তার গন্তব্য হয় ওয়াশিংটন। পেশা হয় কূটনীতি। আর আফ্রো এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে খেলা শুরু করেন তিনি।
জন্মলগ্নেই যেন বিজয়লক্ষীর সবটুকু শুভকামনার বরপুত্র হিসেবেই জন্ম হয়েছিলো তার। একাডেমিক অঙ্গণের মতো কূটনৈতিক অঙ্গণে একের পর এক সাফল্যের বিজয়মাল্য শোভিত হতে থাকে তার গলে। হোয়াইট হাউসের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাকে একইসাথে দেয়া হয় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আর সেক্রেটারী অফ দ্য স্টেটের দায়িত্ব। যা কেবলমাত্র খোদ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতারই সমান্তরাল বলা যায়।
মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থেকে কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অপর কমিউনিস্ট শক্তি গণচীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটে ষাটের দশকের শেষের দিকে। সেসময় ‘শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে চীন মার্কিন মৈত্রী বন্ধন গড়ে তোলার মূখ্য কারিগর ছিলেন কিসিঞ্জার। পরে এই গ্রুপে যোগ দেয় পাকিস্তান। কারণ জন্ম থেকেই ‘চরম শত্রু’ বিবেচনা করা ভারতের তৎকালীন মিত্র ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইতিহাসে এই জোট ‘পিন্ডি -পিকিং-ওয়াশিংটন’ জোট নামেই সমধিক পরিচিত। এভাবেই চীন আর পাকিস্তানের কাধে ভর করে এশিয়াতে ক্রমশ প্রভাব বিস্তার আর উত্থান-পতনের খেলায় মেতে ওঠে মার্কিনীরা। যার সাফল্যের সবটুকু মূলত কিসিঞ্জারেরই প্রাপ্য।
নিজের দায়িত্বপ্রাপ্তকালীন সময়ে এমন কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন যা প্রচণ্ড দূর্ভোগ বয়ে আনে বিশ্বজুড়ে। তার পরিকল্পনাতেই ১৯৬৯ সালে গোপনে বোমাবর্ষণ এবং সামরিক অভিযান চালায় মার্কিন বাহিনী। যার কারণে সেখানকার বৈধ সরকারের পতন ঘটে। কম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করে পলপ্টের রক্তপিপাসু খেমারুজ বাহিনী। সংগঠিত করে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা ও নির্যাতনের বিভীষিকা।
ইরানের সাধারণ জনগণের উপরে নির্মম নির্যাতন চালানো সম্রাট অত্যাচারী শাহ-এর পক্ষে পূর্ণ সমর্থন নিয়ে দাঁড়ানোর পরিকল্পনাটিও ছিল তারই। মার্কিন বলে বলীয়ান হয়েই শাহ এর বাহিনী নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায় রীতিমতো। কিন্তু এখানেও ব্যাক ফায়ার করে তার পরিকল্পনা। নিজেদের সকল দলীয় আর মতাদর্শিক ভেদাভেদ ভুলে একযোগে প্রতিরোধে নামে ইরানের জনগণ। পিছু হটে শাহ আমেরিকাতেই পালাতে বাধ্য হন স্বপরিবারে। আর এরপর এতদিন একসাথে আন্দোলন করা বামপন্থী ও অন্যান্যদের সহজেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে ‘ইসলামিক রেভুলেশন’ সফল করেন আয়াতুল্লাহ খোমেনী। যা দেখে অনুপ্রাণিত হয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের উগ্রপন্থী দলগুলো। বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের এক নতুন অধ্যায়ের হয় সূচনা। যার ফলাফল আজ দেখছে বিশ্ববাসী।
ভিয়েতনাম যুদ্ধকালে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকারকেও সমঝোতার বদলে সংঘাতের পথে যাওয়ার পরামর্শ দেয়ার অভিযোগটাও তার বিরুদ্ধেই। অসংখ্য নিরীহ ভিয়েতনামবাসীর রক্তে ভিজে যায় ভিয়েতনামের মাটি। আর হাজার হাজার মার্কিন সৈন্যের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে চরম লজ্জাকর পরাজয় মাথায় নিয়ে ভিয়েতনাম থেকে বিদায় নেয় মার্কিন শক্তি। যার কারণে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে।
এখানেই শেষ নয়। দেশে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনীর বিপথগামী অংশকে মদদ দিয়ে জনপ্রিয় নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের মূল পরিকল্পনার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। একই কায়দায় চিলির বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট সালভেদর আলেন্দে কে মার্কিনপন্থী সেনা অফিসারদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নৃশংসভাবে হত্যার পেছনে মূল ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে দায়ী করা হয় তাকেই।
কিসিঞ্জারের কূটচালের থাবা একেবারে প্রকাশ্যেই জনসমক্ষে এসে পড়ে ১৯৭১ সালে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। নিজের ব্রেইনচাইল্ড ‘মার্কিন-চীন-পাকিস্তান’ এর অন্যতম শরিক পাকিস্তানের অখণ্ডতা টিকিয়ে রাখতে উল্কার মতো বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালিয়েছেন তিনি। ছুটে গেছেন রাওয়ালপিন্ডি, পাকিস্তানকে আশ্বাস দিতে। সেখান থেকে পিকিং এ, যাতে বাঙালী হত্যার জন্য পাকবাহিনীর অস্ত্র গোলাবারুদের কমতি না ঘটে। গিয়েছিলেন দিল্লীতেও, যাতে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা বন্ধ করে। অন্যথায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দেন। কিন্তু লৌহমানবী খ্যাত ইন্দিরা গান্ধী আর ভারতের তৎকালীন সেনাপ্রধান রীতিমতো অপমান করেন তাকে। সর্বশেষ আর কোনো উপায়ান্তর দেখে তার সব অপকর্মের গডফাদার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে পরামর্শ করে পাঠিয়ে দেন মার্কিন নৌবাহিনীর অন্যতম শক্তিসেল সপ্তম নৌবহর। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে যায় ততক্ষণে। ভারতের অনুরোধে বঙ্গোপসাগরের প্রবেশমুখে পথরোধ করে দাঁড়ায় সোভিয়েত নৌবাহিনী। বাধ্য হয়েই পিছু হটে সপ্তম নৌবহর। অল্পের জন্য আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ দেখা থেকে রক্ষা পায় বিশ্ববাসী।
এভাবে একের পর এক অবিমৃষ্যকারী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ভিয়েতনাম থেকে বাংলাদেশ এর মানচিত্র রক্তে লাল করে দেন এই মানুষটি। ভিয়েতনামে নিহত মার্কিন সেনাদের কবরের সারি আর স্বজনদের আহাজারি ভরিয়ে তুলে খোদ আমেরিকার বাতাস। গড়ে ওঠে তীব্র গণবিক্ষোভ। কিসিঞ্জারের পররাষ্ট্রনীতিকে পর্যবেক্ষণ করলে ধারণা করা যায় যে, মানবতার বা মানুষের প্রাণের কোন মূল্যই ছিল না তার কাছে। রাষ্ট্রের পলিসি বাস্তবায়নই ছিলো তার কাছে মূখ্য। আর সেজন্য যখন যে দেশে যে পদ্ধতি প্রয়োগের প্রয়োজন বোধ করেছেন, সেটাই ব্যবহার করেছেন নির্দয় নির্বিকারভাবে। যখন পৃথিবীর যে প্রান্তে যাকে তার পলিসি বাস্তবায়নে সহযোগী মনে করেছেন, ছলে বলে কলাকৌশলে তাকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। আর যাকে মনে করেছেন বাধা, তাকে পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দিয়েছেন চিরতরে। ভিয়েতনামের লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু তাকে বিচলিত করেনি। পাকবাহিনীর নির্মম বাঙালী হত্যাযজ্ঞকে শুধু সমর্থনই নয়, সহায়তাও করেছেন সর্বাত্মকভাবে। এমনই শীতল কঠিন নিষ্ঠুর হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন এই কিসিঞ্জার।
একসময় কিসিঞ্জারের এই নির্মম পররাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের সচেতন মহলে। বিরোধীদের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ জনগণের সমালোচনার তোপের মুখে পড়েন নিক্সন ও কিসিঞ্জার। সর্বস্তরে দাবী ওঠে তাদের অপসারণের।
একপর্যায়ে ক্রমবর্ধমান গণবিক্ষোভের ফলে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পদত্যাগ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন ভাইস প্রেসিডেন্ট ফোর্ড। তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনেন প্রশাসনে। বলতে গেলে নিক্সনের বিদায়ের সাথে কিসিঞ্জারের বিদায়ঘণ্টাও বেজে উঠেছিল। কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেই ফোর্ড প্রশাসন তাকে আর নিযুক্ত করেননি। রীতিমতো শোপিস হয়ে পড়েছিলেন তিনি। আর ওই অবস্থাতেই শেষ হয় তার কূটনৈতিক জীবন। কিসিঞ্জার ফিরে যান তার একাডেমিক লাইফে। জড়িয়ে পড়েন ব্যবসাতেও।
এরপরও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে রাষ্ট্রীয় ডাকে অনারারি উপদেষ্টা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন জর্জ বুশ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো অনেকের সাথেই। আর প্রতিবারই বিশ্বের কোনো না কোনো প্রান্তে বয়ে গেছে রক্তগঙ্গা! একি শুধুই কাকতলীয়? নাকি এটাই হলো ‘দ্য কিসিঞ্জার ওয়ে’, সেটাও একটা প্রশ্ন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)