জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সর্বশেষ সমীক্ষা (২০১৬) বলছে, মেগাসিটি ঢাকায়, জীবনের প্রয়োজনে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন ১৭০০ জন মানুষ। বছর ঘুরে সে সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ ছাড়ায়। দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ বসবাস করে এ শহরে। যা প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠির জন্য নিত্য-নতুন তৈরি হচ্ছে কর্মক্ষেত্র-আবাসস্থল। এদের অনেকেই জায়গা কিংবা ফ্ল্যাট কিনে স্থায়ীভাবে নাম থাকছেন এ শহরে। এতো গেলো জীবদ্দশার গল্প। কিন্তু মৃত্যু পর কী হচ্ছে? এ শহরে শেষ যাত্রায় অনিবার্য ‘সাড়ে তিন হাত জায়গা’র নিশ্চয়তা কী মিলছে?
এ প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করেছি আমরা। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণে খোঁজ নিয়ে জনা গেছে: ২০০৫ সালের আগ পর্যন্ত ঢাকায় স্থায়ীভাবে কবর কিনে রাখার ব্যবস্থা ছিলো। ঐ বছর ঢাকায় কবর সংরক্ষণ ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। তার পর থেকে দু’বছর ২০০৭ পর্যন্ত সব রকমের সংরক্ষণ বন্ধ ছিলো। ২০০৭’র পর থেকে মেয়াদি সংরক্ষণের সুযোগ দেয় সিটি করপোরেশন। তবে স্থায়ী বন্দোবস্তের পরিবর্তে ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছরের জন্য সংরক্ষণের সুযোগ দেওয়া হয়। তাই এখন আর কেউ চাইলেই সারাজীবনের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে পারবেন না।
সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে: জায়গার অভাবে কবর সংরক্ষণ ব্যবস্থা সীমিত করা হয়েছে। এখন সিটি করপোরেশনের হাতে যতগুলো কবর আছে, তার সঙ্গে নতুন করে কবর যোগ হওয়ার সুযোগ নাই। তাই যে কেউ চাইলেই কবর সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সুপারিশে কখনও কখনও কবর সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া কোন মুক্তিযোদ্ধার দাফনের পর ১০ বছর পর্যন্ত তার কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে।
লাখ থেকে কোটি টাকা লাগে কবর সংরক্ষণে:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট চারটি কবরস্থান রয়েছে। এগুলো হলো: আজিমপুর কবরস্থান, জুরাইন কবরস্থান, মুরাদপুর কবরস্থান ও খিলগাঁও কবরস্থান। এ চারটি ১০, ১৫, ২০ ও ২৫ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণ করতে চাইলে খরচ করতে হবে যথাক্রমে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ লাখ টাকা। আবার এ কবরগুলোয় যদি পুনঃদাফন করা হয় তাহলে খরচ করতে হবে আরও ৫০ হাজার টাকা। তবে এ সংরক্ষণের জন্য সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছ আবেদন করতে হয়। সেই আবেদন গৃহীত হলে তবেই কবর সংরক্ষণ করা যায়।
এটা হলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চিত্র। এবার চোখ ঘোরানো যাক উত্তর সিটি করপোরেশনের দিকে। সেখানে এলাকা ভেদে কবর সংরক্ষণের জন্য গুণতে হয় বিপুল অঙ্কের টাকা। ভিন্ন ভিন্ন জায়গার জন্য ভিন্ন ভিন্ন অঙ্কের টাকা। উত্তর সিটি করপোরেশনে কবর রয়েছে ৬টি। এগুলো হলো: বনানী কবরস্থান, মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার কবরস্থান, উত্তরা ৪ নং সেক্টর কবরস্থান, উত্তরা ১২ নং সেক্টর কবরস্থান ও উত্তরা ১৪ নং সেক্টর কবরস্থান। এ কবর স্থান গুলোতে ১৫ ও ২৫ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে।
এরমধ্যে বনানী কবরস্থানে ১৫ ও ২৫ বছরে জন্য কবর সংরক্ষণের জন্য গুণতে হয় যথাক্রমে ১ কোটি ও দেড় কোটি টাকা। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে এ খরচ ২০ ও ৩০ লাখ টাকা। রায়ের বাজার কবরস্থানে এ খরচ ১০ ও ১৫ লাখ টাকা। উত্তরা ৪ নং সেক্টর কবরস্থানে এই খরচ ৭৫ লাখ ও ১ কোটি টাকা। উত্তরা ১২ নং সেক্টর কবরস্থানে সেই খরচ ৫০ লাখ ও ৭৫ লাখ টাকা। উত্তরা ১৪ নং সেক্টর কবরস্থানে খরচ ৩০ লাখ ও ৫০ লাখ টাকা।
আর সংরক্ষিত কবরস্থান গুলোতে পুনঃকবর দেওয়া হলে বনানীতে গুণতে হবে ৫০ হাজার টাকা। অন্য পাঁচটি কবরস্থানে সেই খরচ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা।
দুই সিটি করপোরেশনেই পুনঃ কবরের ক্ষেত্রে স্বামী, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন ছাড়া অন্য কারও কবর দেওয়ার অনুমতি নেই। এছাড়া যারা কবর সংরক্ষণ করতে চান না বা সংরক্ষণের সক্ষমতা নেই তারা ঢাকা উত্তরে ৫০০ দক্ষিণে ১০০০ টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে মরদেহ দাফন করতে পারবেন। সঙ্গে যোগ হবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেওয়া বাঁশ ও চাটাইয়ের দাম।
দক্ষিণে সংরক্ষণের জায়গা নেই, উত্তরে থাকলেও খরচ বেশি:
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি কবরস্থানের মধ্যে একটিতেও নতুন করে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই বলতে গেলেই চলে। এই সিটিতে ৪টি কবরস্থানে ২৩ হাজার ৫৬০টি কবর রয়েছে। গত ২১৭ বছরের ইতিহাসে এ চারটি কবরস্থানে ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮০০জনকে দাফন করা হয়েছে।আজিমপুরের ৩৫ একর জায়গার মধ্যে কবর সংরক্ষণের জন্য বরাদ্দ সাড়ে তিন একর জায়গা। সেখানে ২ হাজার ৬০০টি কবর সংরক্ষিত রয়েছে। আজিমপুরে পাশেই আড়াই একর জায়গার ওপর রয়েছে ‘আজিমপুর নতুন কবরস্থান’, সেখানে ২ হাজার ৫০টি মরদেহ সংরক্ষিত রয়েছে।
জুরাইনে ১৮.২৩ একর জায়গার ওপর স্থাপিত কবরস্থানে ২ হাজার ৭০০টি কবর সংরক্ষিত রয়েছে। খিলগাঁও কবরস্থানে কবর সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে জানা গেছে: কেউ যদি আগে থেকে সংরক্ষিত কবরে পুনরায় কবরের জন্য আবেদন করেন তাহলে অনুমতি দেওয়া হয়। নতুন করে সংরক্ষণের অনুমতি খুব একটা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ বিবেচনায় মেয়র চাইলে অনুমতি দেন। তাছাড়া, টাকা দিলেই অনুমতি পাওয়া যায় বিষয়টি এমন না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মোট কবর রয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৮১০টি। ২৫ একরের বনানী কবরস্থানে ১০ হাজার ৭৫টি কবর রয়েছে। এরমধ্যে সংরক্ষিত কবর রয়েছে ৭ হাজার ৪০৫টি। আর সাধারণ কবর রয়েছে ২৬৭০টি। ৫৬ একরের মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবর রয়েছে ২৫ হাজার ২৬৪টি। এরমধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে ১২ হাজার ৭৭৫টি। আর সাধারণ কবর রয়েছে ১২ হাজার ৪৮৯টি। ৯৬.২৩ একরের রায়ের বাজার কবরস্থানে মোট কবর রয়েছে ৭০ হাজার ১৯৬টি। এরমধ্যে সংরক্ষিত রয়েছে ২২টি। আর সাধারণ কবর রয়েছে ৭০ হাজার ১৭৪।
উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ২.৫ একরের কবরস্থানে ১ হাজার ৩৭টি কবর রয়েছে। এরমধ্যে ৯৪টি কবর সংরক্ষিত এবং সাধারণ কবর রয়েছে ৯৪৩টি মরদেহ। উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ৩ একরের কবরস্থানে মোট কবর রয়েছে ২ হাজার ২টি। এরমধ্যে মোট ৯৮টি সংরক্ষিত এবং ১ হাজার ৯০৪টি সাধারণ কবর রয়েছে। দেড় একরের উত্তরা ১৪ নম্বর সেক্টর কবরস্থানে ১ হাজার ৩৩২টি কবর রয়েছে। এরমধ্যে ১ কবর সংরক্ষিত রয়েছে। সাধারণ কবর রয়েছে ১ হাজার ৩৩১টি।
সাধারণ মানুষের কবরের জায়গা কোথায়:
সংরক্ষিত বাদে সাধারণ কবরে যাদের দাফন করা হয়, সেই সব কবরে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর তার ওপর আরেকটি নতুন কবর দেওয়া হয়। নতুন কবর দেওয়ার সময় আগের কবরে থাকা মরদেহের অংশ বিশেষ- মাথার খুলি, হাড় তুলে রাখা হয়। নতুন মরদেহ দাফনের সময় সেগুলো আবার নতুন কবরে দেওয়া হয়। তাই প্রিয়জনের মরদেহ ঠিক কোথায় সমাহিত করা হয়েছিলো, একটা সময় পর তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। রায়ের বাজার কবরস্থান বাদে রাজধানীর অন্যান্য কবরস্থানগুলোর চিত্র একই। রায়ের বাজার ৭০ হাজারের বেশি কবর থাকায় সেখানে একটি কবরের ওপর নতুন কবর দিতে কিছুটা সময় লাগে। সেক্ষেত্রে মরদেহের স্মৃতি চিহ্ন কিছুদিন রয়ে যায়।
ঢাকায় কবর সংরক্ষণ নিরুৎসাহীত করতে সিটি করপোরেশন গুলো সংরক্ষণ ফি আগের তুলনায় বাড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলছেন: নির্দিষ্ট মেয়াদে কবর সংরক্ষণের খরচ বাড়ানো হয়েছে। কারণ এমনিতেই কবরের জায়গার সংকট। তাই কবর সংরক্ষণকে নিরুৎসাহিত করতেই এই খরচ বাড়ানো হয়েছে।
কবরের ওপর কবর দেওয়া প্রসঙ্গে কোরআন ও হাদিসে সুনিদৃষ্ট কোন সময়সীমার উল্লেখ নেই। তবে একটি মরদেহ মাটির সঙ্গে মিলিয়ে গেলে সেই জায়গায় নতুন কোন মরদেহের কবর দেওয়া যাবে। ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন: একটি মরদেহ মাটির সঙ্গে মিশে যেতে ছয় মাসের মতো সময় লাগে।
(ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব)