রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছল আজ। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারির রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনকে “অসামরিকীকরণ” করার লক্ষে “বিশেষ সামরিক অভিযান” পরিচালনার জন্য তার সৈন্যদের ইউক্রেনে প্রেরণ করেন।
পুতিনের ঘোষণার পরপরই শুরু হয় ইউক্রেন জুড়ে প্রথম বিস্ফোরণের শব্দ। কিয়েভে ভোরের আলো ফোটার আগেই আঘাত করে একের পর এক রুশ ক্ষেপণাস্ত্র, শহর ছেড়ে পালাতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনবাসী এখনও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয়ে আছে।
যদিও কিয়েভের পশ্চিমা মিত্ররা কয়েক মাস ধরে ধারণা করে আসছিল রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের সম্পর্কে। আক্রমণ শুরু হওয়ার পর সারাবিশ্ব যেন একটি ধাক্কা খায়।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য যখন ঢুকে পড়ে তখন ইউক্রেনের পরাজয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটি দেশের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াইয়ে ইউক্রেন কতদিন টিকতে পারবে, তা নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। কিন্তু এক বছর পর এই যুদ্ধ এখনো চলছে।
যুদ্ধের এক বছরে এসে বেশ কিছু অর্জন রয়েছে দুই দেশেরই। ইউক্রেন যেমন পেয়েছে পশ্চিমাদের বিশেষ সমর্থন এবং সহযোগিতা, তেমনিভাবে রাশিয়ার তার বন্ধু দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবে দুদেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও নেহাত কম নয়। দেশ দুটির বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিহতের খবর পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আহত হয়েছে অনেকে।
ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের থেকে পেয়েছে বিশাল সমর্থন। বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদ , শক্তিশালী ট্যাঙ্কসহ পেয়েছে প্রচুর অর্থনৈতিক সহায়তা। কিয়েভের সৈন্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছে যুক্তরাজ্যসহ অনেকেই। সহজ ভাষায় বলতে গেলে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের সমর্থন অর্জন কিয়েভকে এখনও যুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছে বলে ধারণা অনেকেরই। এছাড়াও রাশিয়ার দখলকৃত বেশ কিছু অঞ্চলও পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে দেশটি। তবে দেশটিতে আক্রমণের ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তার অংকটা খুবই বড়। প্রচুর বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে যুদ্ধের ফলে। দেশ ছেড়ে পালিয়েছে লাখ লাখ নাগরিক।
এদিকে রাশিয়া যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পরেও অনেকটা সামলে নিয়েছে নিজেকে।
বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মাহমুদ আলী বলছেন: এই যুদ্ধ শুরুর সময় রাশিয়ার ঘোষিত লক্ষ্য ছিল তিনটি। প্রথমত কিয়েভে নিউনাৎসীবাদীদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা, দ্বিতীয়ত ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীকে নিরস্ত্র করা, তৃতীয়ত ইউক্রেন যেন কোনদিন ন্যাটো জোটের সদস্য হতে না পারে, তার ব্যবস্থা করা।
তিনি বলেন, যুদ্ধে রুশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, ইউক্রেনীয় বাহিনীও কিন্তু বেশ দুর্বল হয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন ন্যাটো জোটের কাছ থেকে বিপুল সামরিক সহায়তা পেয়েছে, আরও পাবে বলে প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। এসব প্রতিশ্রুতি যদি বাস্তবায়িত হয়, ইউক্রেনের বাহিনী আরও বেশ কিছুদিন যুদ্ধ করার শক্তি পাবে। সুতরাং বলা যেতে পারে ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব হয়নি।
তবে ন্যাটো জোটে ইউক্রেন এখনও যোগ দিতে না পারা রাশিয়ার একটি অর্জনই বলা যায়। যতদিন সেখানে যুদ্ধ চলছে, ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকছে, ততদিন হয়তো ইউক্রেন ন্যাটো জোটের অংশ হতে পারবে না। কাজেই বলা যেতে পারে রাশিয়া তাদের কিছু লক্ষ্য অর্জন করেছে।
যুদ্ধের পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো যে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তার লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করা, একঘরে করে ফেলা। শুরুতে রুশ অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা লেগেছিল। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো যখন একের পর এক রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটাতে শুরু করে, রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো কঠিন করে তোলা হয়, তখন রুশ মুদ্রা রুবলের মানে বিরাট ধস নামে। পরে রাশিয়া সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয় নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিভিন্ন দেশে তেল রপ্তানি করে।
বৃহৎ সামরিক শক্তি হিসেবে রাশিয়ার যে একটা বিরাট ভাবমূর্তি ছিল, এখনও তার পূর্ণ প্রকাশ ঘটেনি তাদের এই যদ্ধে। রাশিয়া এখনও গোটা ইউক্রেনজুড়ে কোন সামরিক হামলা করেনি সাধারণ জনগণের মৃত্যুু হবে বলে। এই ক্ষেত্রে রাশিয়াকে মূল্য দিতে হচ্ছে। প্রচলিত যুদ্ধের বাইরে ব্যাপক প্রাণহানীকর মারণাস্ত্র ব্যবহার না করা রাশিয়ার জন্য একটি দুর্বল দিক। ইউক্রেন ও পশ্চিমারা এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায়।
ইউরোপের অনেক দেশ এখন রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলে গেলেও বাকি বিশ্ব, বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো কিন্তু সেরকম কট্টর কোন অবস্থান নেয়নি। এটা রাশিয়ার জন্য কূটনৈতিক জয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।