নারীদের জন্য ভয়াবহ এক রোগ জরায়ুমুখ ক্যানসার। বিশ্বব্যাপী নারী মৃত্যুর অন্যতম কারণ এটি। সারাবিশ্বে প্রতি ২ মিনিটে মারা যান ১ জন এবং প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হন ৫০ লাখ নারী। দেশে প্রতিবছর ৮ হাজারের বেশি নারীর জরায়ুমুখ ক্যানসার শনাক্ত হচ্ছে এবং নতুন ও পুরাতন রোগী মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫ হাজার নারীর মৃত্যু হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার বিবেচনায় জরায়ুমুখ ক্যানসারের অবস্থান বিশ্বে দ্বিতীয়। দেশে ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় এই জরায়ুমুখ ক্যানসারের মাধ্যমে।
জরায়ুমুখ ক্যানসার হয় হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) থেকে যা ভ্যাকসিন দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এইচপিভি টিকার মাত্র একটি ডোজই জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম যদি তা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সের মধ্যে গ্রহণ করা হয়। এই টিকা বেশ ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার গত ১৫ অক্টোবর রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে অনেকটা নিভৃতেই জরায়ুমুখ ক্যানসারের মত একটি প্রাণঘাতী রোগের বিরুদ্ধে বিনামূল্যে এইচপিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে দেশকে জরায়ুমুখ ক্যানসার মুক্ত করার মহৎ যাত্রা শুরু করেছে।
এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, দেশের লাখ লাখ মেয়ে ও নারীদেরকে জরায়ুমুখ ক্যানসার থেকে রক্ষা করার মাধ্যমে তাদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যত সুরক্ষিত করা। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের বিষয়টি ভাবতেই পারে না সেখানে বাংলাদেশ সরকার এই কর্মসূচির আওতায় পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছাত্রী এবং স্কুলে পড়ে না এমন ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুসহ প্রায় এক কোটিরও বেশি মেয়েদের বিনামূল্যে এই এইচপিভি টিকা প্রদান করার সাহসী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশ সরকার এর আগে ২০২২ সালে শুধু ব্রেস্ট ক্যান্সার ও জরায়ু ক্যানসার শনাক্তকরণ ও প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে।
এই টিকাদান কার্যক্রম প্রথমে ঢাকা বিভাগে শুরু হয়েছে। কর্মসূচির আওতায় ঢাকা বিভাগে ২৩ লাখ কিশোরীকে এই টিকা দেওয়া হবে। পরবর্তীতে সারাদেশে আরও ৮০ লাখ কিশোরীকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রথম পর্যায়ে মোট ১৮দিন এই টিকা দেওয়া হবে। আগামী ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এই টিকাদান কর্মসূচি চলবে। টিকা গ্রহণে উপযুক্ত মেয়েরা ভ্যাক্সেপি অ্যাপ অথবা ওয়েবসাইটে নিবন্ধনের মাধ্যমে তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা মনোনীত টিকাদান কেন্দ্রে এইচপিভি টিকা নিতে পারবে। ইতিমধ্যে স্কুলে এই কার্যক্রম দেখতে অনেক ছাত্রীদের মায়েরা আসছে। সেই সাথে আক্ষেপ জানাচ্ছে তাদের সময় এই কর্মসূচি থাকলে তাদের পরিচিত অনেককে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা যেতো। পাশপাশি তাদের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তারা।
সরকার প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে পৌঁছাতে এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়া ও এইচপিভি টিকা গ্রহণের উপযুক্ত পথ-শিশুদের এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতেও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ঢাকা বিভাগের অন্তর্ভুক্ত কমিউনিটি ক্লিনিক, মাতৃসদনসহ বিভিন্ন জায়গায় স্পট রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করেছে। এই উদ্যোগ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ উভয় ক্ষেত্রে দেশের নারীদের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে তাদের স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণে বাংলাদেশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এই টিকাদান কর্মসূচি।
এই টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দ্যা গ্লোবাল ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। দেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং শিক্ষক, বাবা-মা ও ধর্মীয় নেতাদের বিস্তারিত ধারণা প্রদান করা হয়েছে, যাতে কোন মেয়ে এই টিকাদান কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে। তাই এইচপিভি টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে উপযুক্ত কিশোরীদের সহায়তা করার জন্য সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। তাই আপনার আমার সামান্য সহায়তা সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমের এই মহতী উদোগকে সাফল্য মন্ডিত করতে পারে।
ইতিমধ্যেই সরকার টিকা দ্বারা প্রতিরোধযোগ্য রোগের বিরুদ্ধে টিকা প্রদানের মাধ্যমে মা ও শিশু মৃত্যু এবং পঙ্গুত্ব রোধে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেছে। বৈশ্বিক কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবেলাতেও বাংলাদেশ সারাবিশ্বে নিজেকে রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশে টিকাদান কার্যক্রমের অসামান্য সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালে গ্যাভি কর্তৃক ভ্যাকসিন হিরো সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)